মুহূর্তের বিস্ময়
ইতালো ক্যালভিনো
ভাষান্তর: মহীবুল আজিজ
একদিন এক চৌরাস্তার মাথায় ব্যাপারটা ঘটল, ভিড়ের মাঝখানে, লোকজন আসছে আর যাচ্ছে।
আমি থেমে পড়লাম, চোখের পলক ফেললাম—আমি কিছুই বুঝলাম না। কিছু না, কোনো কিছু সম্পর্কেই কিছু না। জিনিসপত্র সম্পর্কে কোনো যুক্তিই আমার বোধগম্য হলো না, না লোকজন সম্পর্কে—সবকিছুই ছিল অর্থহীন, উদ্ভট। আর আমি হাসতে শুরু করে দিলাম।
ওই সময় আমার কাছে যেটা খুব অদ্ভুত ঠেকল, যা আমি আগে কখনো বুঝতে পারিনি। সে সময়টার আগ পর্যন্ত আমি বুঝিনি যে আমি সবই মেনে নিয়েছিলাম: ট্রাফিক লাইট, গাড়িঘোড়া, দেয়ালের পোস্টার, ইউনিফর্ম, মনুমেন্ট—পৃথিবীর যাবতীয় বোধসমূহ থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত জিনিসপত্র। মেনে নিয়েছিলাম যেন বা সেসবের কোনো না কোনো প্রয়োজন রয়েছে। কার্য এবং কারণের কোনো সূত্র সেসবকে একসঙ্গে বেঁধেছে।
তারপর হাসিটা মিলিয়ে গেল আমার বুকের গহিনে, আমার মুখটা লালচে ভাব নিল, আমি লজ্জা বোধ করলাম। লোকজনের মনোযোগ আকর্ষণ করতে আমি হাত নাড়াতে থাকলাম, চিৎকার করে বললাম, ‘দাঁড়াও এক সেকেন্ড।’ চিৎকার করে বলি আমি, ‘কোথাও কোনো একটা ভুল হয়ে গেছে! সব ভুল! আমরা অসম্ভব উদ্ভট সব কাজ করছি! এটা সঠিক রাস্তা নয়! এর শেষ কোথায়!’
লোকজন আমার চারদিক ঘিরে দাঁড়ায়, কৌতূহলের সঙ্গে আমাকে বোঝার চেষ্টা করল তারা। আমি দাঁড়ালাম তাদের মাঝখানে। হাত নেড়ে নেড়ে নিজের যুক্তি তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা আমার মধ্যে। যে বোধের চকিত আলোকরেখায় আমি অকস্মাৎ আলোকিত হয়ে উঠলাম, তার অংশীদার করতে চাইলাম ওদেরকে। এবং আমি কিছুই বললাম না। বললাম না, কারণ যে মুহূর্তে বলার জন্য হাত উঁচু করলাম, মুখটা খুললাম, আমার অসাধারণ সেই ব্যক্ততাকে ফের আমাকেই গিলে ফেলতে হলো। যে কথাগুলো তখন বেরিয়ে এসেছিল কোনো একভাবে, হয়তো বা মুহূর্তের আবেগে।
‘তো?’ লোকজন প্রশ্ন করে, ‘কী বলতে চান আপনি? সবকিছু যার যার জায়গামতো আছে। যেভাবে থাকা উচিত সব সেভাবেই আছে। প্রত্যেকটাই অন্য কোনো একটার ফল। প্রত্যেকটা অন্য একটার সঙ্গে ঠিকঠাকমতো খাপ খাচ্ছে। কোনো কিছুই আমাদের উদ্ভট কিংবা অসংগত বলে মনে হচ্ছে না।’
এবং আমি সেখানে দাঁড়ানো, পথভ্রান্ত যেহেতু তখন আমার মনে হচ্ছে সবকিছু এসে গেছে জায়গামতো এবং সবকিছুই মনে হচ্ছিল স্বাভাবিক—ট্রাফিক লাইট, মনুমেন্ট, ইউনিফর্ম, আকাশছোঁয়া অফিস ভবনগুলো, ট্রামলাইন, ভিক্ষুকের দল, মিছিল—তবু এসবে আমার প্রশান্তি আসে না, আমাকে পীড়িত করতে থাকে।
‘দুঃখিত’, আমি বললাম, ‘হয়তো ভুলটা হয়েছে আমারই। আমার সে রকমটাই মনে হয়েছিল। কিন্তু সব ঠিকই আছে। আমি দুঃখিত।’ তাদের ক্রুদ্ধ চাহনির সামনে দিয়ে আমি সরে পড়লাম।
তথাপি, এমনকি এখনো, প্রত্যেকবার (প্রায়শ) আমার মনে হয় যে কিছু একটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। তখন একটা স্বভাবজাত আশাবাদে আমি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি, হয়তো একদিন এই মুহূর্তটা হবে আমারই, ফের হয়তো আমি কিছুই বুঝে উঠব না। সেই আরেক জ্ঞান আসবে আমার নাগালে। আমি তা পাব এবং হারাব এক মুহূর্তেই।
[ইতালো ক্যালভিনো (১৯২৩-১৯৮৫), জন্ম কিউবায়, মৃত্যু ইতালিতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উত্তর ইতালিতে জার্মান সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি। অদৃশ্য শহর, শীতের রাতে যদি কোনো পর্যটক প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর কুড়িটির মতো বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। বহু বিখ্যাত সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন ক্যালভিনো। তাঁর ‘ফ্ল্যাশ’ গল্পের ভাষান্তর গল্পটি।]
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply