আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ও কথাসাহিত্যিকেরা নিজের ভাষার লেখকদের সম্পর্কে লিখলেও বিদেশি লেখক বা চিরায়ত সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের ভাবনা, মতামত বা প্রতিক্রিয়া কালে-ভদ্রে লেখেন। লিখতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা অবশ্য নেই। তবে কেউ লিখলে সেটা আমাদের জন্য অবশ্যই বাড়তি পাওনা। কথাসাহিত্যিক ওয়াসি আহমেদ আমাদের সেই বাড়তি পাওনার অংশীদার করেছেন দেখে আমি আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ।
বোর্হেস সম্পর্কে যেসব বিশেষণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে তিনি ‘হোর্হে লুইস বোর্হেস: বেলা শেষের গল্প’ (‘সাহিত্য সামময়িকী’, ১৭ ডিসেম্বর ২০১০) প্রবন্ধটি শুরু করেছেন, তা কিছুটা যথাযথ এবং অংশত সত্যি। তবে ‘ব্যক্তিগত জীবনে’ ‘একরোখামি’ থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু ‘লেখালেখিতেও নিজস্ব ধ্যানধারণার প্রতি তাঁর একরোখামি সুবিদিত’ ছিল—এমন বক্তব্য কতটা সত্যি, তা নিয়ে আমার কিছুটা সংশয় আছে। ওয়াসি আহমেদ এর পরের বাক্যে এও বলছেন যে ‘নিজের লেখালেখির ওপর অবিচল আস্থাও তাঁকে অনেকের কাছে রাইটার্স রাইটার হিসেবে চিহ্নিত করেছে।’ ওয়াসি আহমেদের এ রকম মনে করার কারণ বা উৎস হতে পারে দুটো। এক. বোর্হেসের লেখা পড়ে। দুই. নিজের লেখা সম্পর্কে বোর্হেসের কোনো মন্তব্য, লেখা বা আলাপচারিতা। এই দুইয়ের বাইরে আর কোনো সম্ভাব্য উৎস আছে কি না, জানি না।
প্রথমেই দেখা যাক উৎস হিসেবে বোর্হেসের জগৎটিকে। ওয়াসি আহমেদ যদিও আমাদের বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যা করে দেখাননি কী অর্থে বা কেন একরোখা বোর্হেস। তবে ব্যাখ্যা না করলেও বোঝা যাচ্ছে, তিনি হয়তো লেখার শৈল্পিক আস্থার কথা বলতে চান। কিন্তু সেটা বোঝানোর জন্য ‘একরোখামি’ শব্দটা বেমানান বলে মনে হয়। যদি শৈল্পিক আস্থার দৃঢ়তা না বুঝিয়ে ধারণার ক্ষেত্রে গভীর আস্থার কথা বুঝিয়ে থাকেন, সেখানেও এই শব্দটিকে বোর্হেসের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া মুশকিল। কারণ, ধারণা এবং শৈল্পিক কুশলতার ক্ষেত্রে বোর্হেসের বৈচিত্র্য এত বেশি যে তাঁকে কোনো একটি বিষয়ে একরোখা এবং অবিচল আস্থাশীল ভাবাটা শূন্য থেকে কোনো কিছু তৈরি করার মতো ব্যাপার। তিনি প্রবন্ধের শেষের দিকে বোর্হেসের প্রথম দিককার গল্প ‘ট্লন, উকবার অরবিস তারতিয়াস’, ‘লটারি অব ব্যাবিলন’, ‘দি গার্ডেন অব দ্য ফর্কিং পাথস’, ‘সাউথ’-এর উল্লেখ করেছেন। এগুলোর একটার সঙ্গে আরেকটার ধারণাগত বা শৈল্পিক কোনো ‘একরোখামি’ রয়েছে? একরোখা বলতে কি এই বোঝায় না যে, যা বিশ্বাস করেন তা গোঁয়াড়ের মতো ধরে বসে থাকেন বা তা থেকে একটুও নড়েন না? এই অর্থে বোর্হেসে ‘একরোখামি’ কোথায়?
এই ধাঁধার সম্ভাব্য উত্তর পাওয়ার জন্য যদি আমরা দ্বিতীয় উৎসের দিকে, অর্থাৎ নিজের লেখা সম্পর্কে বোর্হেসের মন্তব্য ও আলাপচারিতার দিকে তাকাই, সেখানে এমন কোনো গভীর ‘অবিচল আস্থা’র উল্লেখ আমার চোখে পড়েনি কখনো। আমি যে তাঁর সব আলাপচারিতা বা মন্তব্য পড়ে ফেলেছি, সেটা বলব না। তবে যেটুকু পড়েছি, তাতে বোর্হেসকে অবিচল আস্থা নিয়ে কখনো হাজির হতে দেখিনি। আলাপচারিতায়, আড্ডায় নিজের সম্পর্কে তিনি ছিলেন সব সময়ই বিনয়ী, নিজের প্রতিভার ব্যাপারে প্রায় আস্থাহীন। পাঠক কর্তৃক এমনকি নিজের লেখার ভুল পাঠকেও শ্রদ্ধা ও বিনয়ের সঙ্গে মেনে নিয়ে বলতেন, আপনি আমার লেখাটিকে এই পাঠের মাধ্যমে সমৃদ্ধ করলেন। ওয়াসি আহমেদ হয়তো বলতে চেয়েছেন, যা তিনি উল্লেখ করেনি—এই যে শিল্পকুশলতায় বোর্হেস যে উচ্চতায় পৌঁছেছেন, তা গভীর ও নির্ভুল আস্থা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই সত্য সব মহান শিল্পীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সেটাকে ‘একরোখামি’র মতো একটা চণ্ড-শব্দ দিয়ে আলাদা করে বলার কী আছে।
ওয়াসি আহমেদের এই লেখাটি মূলত বোর্হেসের গল্পের বই ডক্টর ব্রডিস রিপোর্ট পাঠের প্রতিক্রিয়া। গ্রন্থের মুখবন্ধে বোর্হেসের ‘চিন্তাভাবনার দিক পরিবর্তন’কে ‘চমকপ্রদ’ বললেও শেষে ‘অবোর্হেসীয়’ বলে উল্লেখ করেছেন। দিক পরিবর্তন করার কারণে কেন অবোর্হেসীয় হলো? ডক্টর ব্রডিস রিপোর্ট-এর গল্পগুলোতে কি বোর্হেসের সাহিত্যিক স্বভাবসুলভ ব্যক্তিত্বের কোনো ছায়া নেই? কিপলিংয়ের আদর্শে ‘সোজাসাপ্টা(?) প্রকাশভঙ্গি গ্রহণ’ করেছেন বলে গল্পকার হিসেবে বোর্হেসের আগের বৈশিষ্ট্যের কিছুই নেই? বোর্হেস বলেছেন বটে সোজাসাপটা, কিন্তু বোর্হেসের বিনয়ের ফাঁদে পড়ে আমাদের কেন তাঁর কথাকেই মানদণ্ড বলে ধরে নিতে হবে? আর বোর্হেস বললেন বলেই ‘দ্য গসপেল অ্যাকর্ডিং টু মার্ক’কে এই গ্রন্থের শ্রেষ্ঠ গল্প বলে মেনে নিতে গেলে আমার মধ্যে যে আশঙ্কাটা দেখা দেয়, তা হলো আমরা লেখকের মন্তব্যের ওপর নির্ভর করে একটা লেখার গুণাগুণ নির্ধারণ করতে গিয়ে নিজের ধরনে উপভোগ করা থেকে বঞ্চিত হই। কখনো কখনো এ ধরনের মন্তব্য যে লেখকের অজান্তে বা অনিচ্ছায় প্রতারণার জাল হিসেবে ছড়িয়ে থাকে, তা আমরা ভুলে যাই। ফলে এই জাল ছিঁড়ে স্বাধীনমতো নিজের পছন্দকে প্রবেশ করতে দিই না লেখার প্রচ্ছন্ন মাত্রাগুলোকে ছুঁয়ে দেখার জন্য বা আবিষ্কার করার জন্য। বোর্হেস একসময় মনে করতেন ‘রাস্তার কোণের লোকটি’ তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্প। কিন্তু তাঁর বন্ধু এবং অনুবাদক নরমান টমাস ডি জোভান্নি এ ব্যাপারে একমত না হওয়ায় তিনি সেই দাবি থেকে পিছিয়ে আসেন। আমি নিজেও এটিকে বোর্হেসের শ্রেষ্ঠগল্প মনে করি না। এই গ্রন্থে আমি মনে করি, বোর্হেস না বলে থাকলেও সবচেয়ে দুর্দান্ত এবং জমকালো গল্প আসলে ডক্টর ব্রডিস রিপোর্ট। ‘মুখবন্ধ’ উপেক্ষা করলে ওয়াসি আহমেদ হয়তো অন্য আরও দু-একটি গল্প আবিষ্কারের স্বাধীনতা পেতেন। আর গল্পগুলো যে বোর্হেস কথিত ‘সোজাপ্টা’ নয়, এই বিশ্বাস তাঁর মধ্যে দানাবাঁধার সুযোগ পেত না যদি বোর্হেসের মন্তব্যকে তিনি মুখ্য ধরে না নিতেন। তাঁর লেখাটি যতটা না গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো নিয়ে তাঁর নিজস্ব অবলোকন তার চেয়ে বেশি এই গ্রন্থে বোর্হেসের ‘মুখবন্ধ’নির্ভর একটি আলোচনা হয়ে উঠেছে।
আরেকটি কথা তিনি বলেছেন, ‘আগে কখনো জয়েসকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করলেও বোঝা যায় শেষ বয়সে জয়েসকে তিনি নস্যাৎই করলেন।’ জানি না, জয়েসকে তিনি ‘নস্যাৎ’ করেছেন কি না। কিন্তু আগে কখনো জয়েসকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেননি—এটা কিন্তু তথ্য হিসেবে ঠিক নয়। বোর্হেস একেবারে তাঁর প্রথম যৌবনে জয়েস নিয়ে লেখা শুরু করেন। তাঁর প্রথম প্রবন্ধের বইয়ে (ইনকিসিসিওনেস, ১৯২৫ সালে প্রকাশিত এবং এই বইটিকে পরে তিনি অস্বীকার করেছেন) ‘এল উলিসেস দে জয়েস’ নামে ছয় পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ১৯৩৭ সালের ৫ ডিসেম্বরে ‘জেমস জয়েস’ নামে লেখেন আরেকটি ছোট প্রবন্ধ। ১৯৩৯ সালের ১৬ জুনে একটি ছোট প্রবন্ধ লেখেন ‘এল উলতিমো লিবরো দে জয়েস’ নামে। পাঁচ মাসের ব্যবধানে লেখেন ‘জয়েস ই লোস নিওলোগিসমোস’ নামে তিন পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ। ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেখেন ‘ফ্রাগমেন্তোস সোবরে জয়েস’ নামে আড়াই পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ। পাঁচটি প্রবন্ধ লেখার পরও কি বলা যাবে তিনি আগে কখনো জয়েসকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেননি? এই প্রবন্ধগুলো এলিয়ট ওয়েইবার্গারের সম্পাদনায় ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত বোর্হেসের সিলেক্টেড নন-ফিকশন বইয়েও আছে।
ওয়াসি আহমেদ ডক্টর ব্রডিস রিপোর্ট সম্পর্কে বোর্হেসের উদ্ধৃতি দিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, ‘গল্পগুলোয় তিনি সাধ্যমতো সোজাসাপটা প্রকাশভঙ্গি গ্রহণ করেছেন।…এ প্রসঙ্গে যাঁকে তিনি স্মরণ করেছেন, স্মরণই নয়, কুণ্ঠাহীনভাবে যাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের কথাও উচ্চারণ করেছেন, তিনি ইংরেজ কিপলিং।’ এবার ওয়াসি আহমেদ পরিষ্কার নিজের মত জানিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, শেষ বয়সে বোর্হেস কিপলিংকে গ্রহণ করেছেন।’ অতএব কিপলিংকে গ্রহণ করা মানেই তাঁর সোজাসাপটা প্রকাশভঙ্গি গ্রহণ করা। কিন্তু গোল বাধে যখন ওয়াসি আহমেদ একটু পরে বলেন, ‘বোর্হেসের গল্পের বর্ণনাভঙ্গি সেই শুরু থেকেই বলা চলে সোজাসাপটা।’ প্রথম সমস্যা হলো এটি পরস্পর বিরোধিতায় আচ্ছন্ন। দ্বিতীয়ত, বোর্হেস প্রথম থেকেই যদি সোজাসাপটা ছিলেন, তাহলে শেষ বয়সে কিপলিংয়ের হাত ধরে আবার সোজা হওয়ার দরকার হলো কেন? এ তো গেল সোজাসাপটার দিক। এবার আসা যাক বোর্হেসের গল্পের ‘জটিলতা’ এবং ‘বাহুল্য’ প্রসঙ্গে। ওয়াসি আহমেদ ব্রডিস রিপোর্ট-এর আলোচনা প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন যে ‘টান টান ভঙ্গির প্রয়োজনে আখ্যানের বয়ানে জটিলতা তিনি (বোর্হেস) অনেকটাই পরিহার করেছেন, উপস্থাপনা কৌশলও বাহুল্যবর্জিত।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই গ্রন্থে এসে যদি ‘আখ্যানের জটিলতা তিনি অনেকটাই পরিহার করে থাকেন, তাহলে ‘শুরু থেকেই’ ‘সোজাসাপ্টা’ ছিল বলা যায় কি? আর আগের গল্পগুলোর উপস্থাপনাকৌশলে কী এমন বাহুল্য ছিল, যা শেষ বেলার গল্পে এসে বর্জন করলেন? শুধু মুখবন্ধের ওপর নির্ভর না করে যদি তিনি আগের এবং পরের গল্পগুলোকে একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতেন, তাহলে প্রবন্ধটিতে এত স্ববিরোধিতার সমাবেশ ঘটত না। তথ্যের ক্ষেত্রেও তিনি বিভ্রান্তিগুলো এড়িয়ে যেতে পারতেন। তা না হওয়ায় লেখাটি বোর্হেসের এই গল্পগ্রন্থ সম্পর্কে লেখক বা পাঠক ওয়াসি আহমেদের নিজস্ব অবলোকনের পরিবর্তে হয়ে উঠেছে বোর্হেসের মুখবন্ধের বিশ্বস্ত প্রতিধ্বনি। কারণ, ব্রেখটের প্রসঙ্গটুকু বাদে বাকি সবই ওই মুখবন্ধের সারাৎসার।
রাজু আলাউদ্দিন
ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জানুয়ারী ০৭, ২০১০
Leave a Reply