ঘরের বাইরে মিথিলার পেইন্টিং দিয়ে মোড়ানো দেয়াল। সারিবদ্ধ নানা প্রজাতির গাছের সমারোহ দরজা খোলার অপেক্ষাকে দীর্ঘ করে না। দরজা পেরিয়ে ঘরে ঢুকেই বিশাল পরিসর। এক পাশে পরিপাটি করে সাজিয়ে বসার আয়োজন, দেয়ালে পরিচিত-অপরিচিত নানা ধরনের পেইন্টিংশিল্পের ভুবনে আমাদের স্বাগত জানায়। ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে ক্যাটালগ, জার্নাল, বই, বইয়ের শেলফ, গান শোনার ব্যবস্থা। অন্য পাশে শিল্পী নিবিষ্ট মনে কাজ করে চলেছেন। আশপাশে সাজানো রয়েছে নানা আকৃতির ক্যানভাস, রং-তুলি-ব্রাশ-কলম-জলপাত্রসহ ছবি আঁকার উপকরণ। কোনো শিল্পীর স্টুডিও এত পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন হতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঝকঝকে মেঝে, গোছানো আসবাবপত্র, পরিচ্ছন্ন দেয়াল, কোথাও কোনো রং গড়িয়ে পড়ছে না, কাজের সময়ে শিল্পীর অগোচরে ছিটকে যাওয়া রংগুলোর তাহলে কী হয়!
বাংলাদেশকে শিল্পবলয়ে এ সময়ে যাঁরা সমৃদ্ধ করছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শিল্পী রোকেয়া সুলতানা। তিনি অত্যন্ত অমায়িক, মৃদুভাষী, উচ্ছল। সাধারণ জীবন-যাপন করেন। তাঁর বর্ণময় শৈশবের বেশ কিছু বছর কেটেছে করাচিতে। শৈশবের নানা ছায়া তাঁর জীবনে রয়েছে, ছেলেবেলার বিভিন্ন অম্লমধুর স্মৃতির সঙ্গে নতুন কিছু যোগ করে করেই তিনি পরবর্তী পথ তৈরি করেছেন। নিজস্ব শিল্পবোধ সম্পর্কে তিনি বলেন, সৌন্দর্যের প্রতি আকাঙ্ক্ষা মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই। তার চেতনা প্রকৃতির সঙ্গে নিবিষ্ট এবং ঘনিষ্ঠ। তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক তত্ত্বের বাইরে গিয়ে শুধুই প্রকৃতি থেকে শিল্পের উপকরণ নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন। জীবনকে তিনি জল-মাটি-বাতাসের সরলতায় খুঁজে বেড়িয়েছেন। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে তাঁর শিল্পসত্তায়, নানা বর্ণময়-প্রতীকে শিল্পে এর প্রতিফলন ঘটছে প্রতিমুহূর্তে। সৃষ্টিশীল মননের স্বাধীন অভিব্যক্তি শিল্পেই শুধু সম্ভবপর হয়। তাই শিল্পীর স্বাধীনতা এবং অনুকূল পরিবেশ ছাড়া মহৎ শিল্প নির্মিত হয় না। শিল্পে কোনো লিঙ্গভেদ থাকার কথা না থাকলেও নারীদের শিল্পী হয়ে ওঠা প্রতি মুহূর্তের যুদ্ধের মতো। শিল্পী হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নারীদের যেসব বাধা তা শিল্পের প্রতি তীব্র ভালোবাসা আর দৃঢ়তায় অতিক্রম করতে হয়। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা বলেন, ‘আমি নারী এটা স্পষ্ট, আমার আচার-আচরণ-দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। এই ফেমিনিন কোয়ালিটি ভিন্ন মাত্রা তৈরি করে। নারীর মানবিকতা, দায়িত্বশীলতা, জীবনবোধের গভীরতা অনেক তীব্র। পরিবার-সমাজ-সংসারের প্রতি কর্তব্য এবং আরোপিত নিয়ম নারীর সৃজনশীলতার প্রতি হুমকি হয়ে ওঠে।
রোকেয়া সুলতানার সফলতার পেছনে নিরন্তর কাজ করে অধ্যবসায়, একাগ্রতা এবং নিজের প্রতি আস্থা। একটি নির্দিষ্ট পরিসরকে কী করে দক্ষতার সঙ্গে দৃশ্যশিল্পে রূপান্তর করতে হয় তা তিনি আয়ত্ত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় স্নাতক তিনি। শান্তিনিকেতনে এম ফাইন করার সময় মূলত তাঁর চিত্রভাষায় নিরীক্ষাধর্মিতা চিত্রে বা প্রিন্টে বিষয়ভিত্তিক ভাবনাকে কেন্দ্রীভূত করেছে। তাঁর শিল্পের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, মননশীলতা, সর্বোপরি তাঁর নিজস্ব শিল্পদর্শন পাওয়া যায়। তাঁর কাজে এসেছে বিষয়কেন্দ্রিক ভাবনা, প্রতীকী আকারে নানা রূপকের ব্যবহার এবং বাস্তবধর্মী নানা উপাদান। এ ছাড়া ব্যক্তিগত জগতের দুঃখবোধ, আবেগপ্রবণ অনুভূতি, নারীর একাকিত্ব এবং অস্তিত্বের প্রশ্ন তাঁর চিত্রপটকে আবেগময়, সরলতাপূর্ণ এবং একাধিক মাত্রায় উন্নীত করেছে। বিমূর্ত চিত্রপটের ওপর সরল ভঙ্গিতে আঁকা ড্রয়িংধর্মী ফিগারগুলোতে নিশ্চয়তা ও অনিশ্চয়তার দোলাচল আছে। রোকেয়ার সংসারজীবনে প্রবেশ, সন্তান ধারণ ও কন্যাসন্তানের জননী হওয়া এবং ব্যস্ত নগরের পরিমণ্ডলে বসবাস—এ সবকিছুই তাঁর ব্যক্তি ও শিল্পীজীবনকে নতুন এক অভিজ্ঞতা ও ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। রোকেয়া সুলতানার কাজ করার পরিবেশ আরও সুখময় হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনসঙ্গী সংগীতের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুবাদে।
স্টুডিওতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন আকৃতির ক্যানভাসের অনেকগুলোই অসমাপ্ত। শিল্পী রোকেয়া সুলতানা একসঙ্গে কয়েকটি ক্যানভাসে কাজ করেন, রং শুকাতে সময় লাগে তাই কালক্ষেপণ না করে নতুন আরেকটি কাজ শুরু করেন তিনি। এভাবেই তাঁর স্টুডিও রঙিন হয়ে ওঠে। তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করেন ক্যানভাস থেকে ক্যানভাসে। শিল্পীর স্টুডিওতে সারি সারি কাজ, কাগজ, ছাপচিত্রের নানা অনুষঙ্গ, প্রয়োজনীয় সব রঙের কৌটা, কালি-কলম, স্কেচখাতা এবং আপন চেতনাবলয়ে নিমগ্ন হয়ে তিনি বের করে আনেন অদেখা পৃথিবীর নতুন আস্বাদ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০১০
Leave a Reply