হবু ‘মরহুম’ শওকত চৌধুরী তাঁর নিপাট জীবনটির রেশ মরণের পরেও কয়েকটি দিন ধরে রাখতে চান। তাই নিজের মৃত্যুপরবর্তী শেষকৃত্যাদিরও একটা পূর্ণাঙ্গ মহড়া তদারক করে সেসব হুবহু অনুসরণ করার অনুরোধ জানান সবাইকে—যাতে অনুষ্ঠানগুলোতে কোনোরকম নান্দনিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, এমনকি রাজনীতিক ত্রুটিও না থাকে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রাজনীতিক ত্রুটি আবার কেমন? যেমন অমুক অমুক দলের কেউ থাকবে না।
দরজি ডেকে শরীরের নির্ভুল মাপ নিয়ে সে অনুযায়ী দক্ষ কবর-খনক ডেকে গোরটি ক্ষুদে নিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ কবরে শুয়েও দেখেন এলাকার সর্বজনশ্রদ্ধেয় ‘চদরিসাব’—গোরে তিনি ঠিক ফিট করছেন কি না। গোরস্থ হওয়ার পরেও তাঁর মরদেহের কাফন যেন একটুও অপরিচ্ছন্ন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে বাঁশের ছাউনি বানিয়ে তার ওপর এক পরত মাটি দেওয়ার পরেও কণামাত্র মাটি কাফনের কাপড়ে না পড়তে দেখে সন্তুষ্ট মনে কবর থেকে উঠে আসেন সর্ববিষয়ে পরিচ্ছন্নতাপ্রিয় শওকত চৌধুরী।
তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ঢাকাবাসী গোফরান না-বলে পারে না: ‘কবরটা তোর নিজের অট্টালিকার অদূরে বনানী গোরস্থানে হলে বেশি মানানসই হতো না? ঢাকার বড়লোকেরা তো বনানী গোরস্থানকে আভিজাত্যের মরণোত্তর প্রতীকই জ্ঞান করে।’
চৌধুরীসাহেবের তাচ্ছিল্যভরা জবাব: ‘ওই গণগোরস্থানে পারিবারিক কবরস্থানের আভিজাত্য থাকে না। তাছাড়া আমাদের চুনতির এই পারিবারিক কবরস্থানটি তো যেন ছায়াতরু আর পুষ্পবৃক্ষের চাঁদোয়াঢাকা স্বর্গোদ্যানেরই একটা নমুনা!’
কেউ একজন বলে ওঠে: ‘হুজুর, দাফনের ফরে ত বেয়াকগুনেরে খানাফিনা খাবান ফরে।’
‘খাবাইয়ম ত বা-জি—বেয়াককিন জোগার আছে।’
তাও সুসমাপ্ত হয় চৌধুরীসাহেবের তত্ত্বাবধানে। প্রচুর ঝালগোশত-সহকারে লালচালের ভাত খেয়ে হবু মরহুমের আত্মার মাগফিরাতের জন্য মোনাজাত করে সকলে।
মোনাজাতসিদ্ধ পবিত্র হস্তে মুখ মুছেই কে একজন স্মরণ করায়: ‘এই লগে চাইরদিননা খ-নঅ বাদ থাইতো কিল্লায়।’
‘বাদ থাইবো ক্যানে, হিবাও অইবো।’
তৃতীয় দিনে সে মহড়াটিও অনুষ্ঠিত হয় চৌধুরীসাহেবের ব্যক্তিগত তদারকিতে। সে মহড়াটির তেহারি খাওয়ার পরেও একজন বলে ওঠে: ‘তোইলে বা-জি, এই লগে চল্লিশার শ্যাষখানা—ইবা কিল্লায় বাদ যাইতো?’
তাও বাদ যেতে দেন না খুঁটিনাটি বিষয়ে বিশেষ মনোযোগী চৌধুরীসাহেব—যদিও তিনি এলাকার এসব মাতবরকে হাড়ে হাড়েই চেনেন, এমনকি পরের দুজনের প্রস্তাবের নিহিত বিদ্রূপের সুরটিও নির্ভুল বোঝেন। এই সুর যে তাঁর ‘শৌখিন শওকত’-ডাকা ইয়ার-বন্ধুদের মশকরার সুর থেকে আলাদা, তাও তিনি জানেন। তাই ঘটনাগুলোকে চৌধুরী-চরিত্রের আপসহীন অখণ্ডতার চূড়ান্ত প্রমাণও জ্ঞান করা যায়। চৌধুরীসাহেবের জনপ্রিয়তার প্রধান উপাদান উদারতা, দানশীলতা, সহমর্মিতা, ন্যায়পরতা এবং সর্বোপরি তাঁর চরিত্রের অটুটতা।
সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামে তিনি কেবল চৌধুরীসাহেব নামেই পরিচিত। শুধু-পদবি দিয়ে শনাক্তযোগ্য একমাত্র শওকত চৌধুরীই। সাতকানিয়ার (বর্তমান লোহাগাড়া থানার) চুনতি গ্রামের অভিজাত এক প্রাচীন বংশের ধনী সন্তান তিনি। বংশগত পুরাতন ব্যবসা তাঁদের কাঠের। তাঁর কালের বৃহত্তর ব্যবসা পরিবহনের। কাঠের ব্যবসাটির প্রধান কেন্দ্র দোহাজারি নিকটবর্তী বিধায় তিনি সপরিবারে নিরিবিলি পাহাড়ি শহর বান্দরবানে থাকতেই পছন্দ করেন। তাছাড়া কাঠের প্রধান উৎস তো পার্বত্য চট্টগ্রামই।
পাঠক, এসব গালগল্প ভাববেন না। কেননা এসবের মধ্যে লেখক নিজেও আছেন—ঘটনাবলির কেবল নিষ্ক্রিয় সাক্ষী হিসেবে নয়, সক্রিয় অংশী হিসেবেও। তিনি তখন বান্দরবানের মহকুমা-হাকিম ছিলেন। চৌধুরীসাহেবের বিরুদ্ধে প্রথমে চট্টগ্রামের এসডিও-সাউথের কোর্টে কমপ্লেন কেসের আর্জি পেশ করে জেলার চিহ্নিত এক মামলাবাজ, সাক্ষী হিসেবে নামকরা একজন আলেম আর বাদী হিসেবে এলাকার এক মসজিদের এমামকে নিয়ে এসে। বিবেচ্য বিষয়টি স্পর্শকাতর বিবেচনায় এসডিওসাহেব কেসটি অন্য কোর্টে ট্রান্সফার না করে নিজেই শুনানি গ্রহণ করেন এজলাসে বসে। চৌধুরীসাহেবের উকিল বলেন: ‘পারিবারিক গোরস্থানের জিন্দা কবরের ওপর বিশেষ কোনো জাতের ঘাস বা ফুলের চাষ, সিরামিকের দেয়াল, মার্বেলের সমাধি-শিলালিপি ইত্যাদি—কত কিছুই তো করে কত জনে। তাতে সমাজ তো কোনো বাধা দেয় না।’
প্রতিপক্ষের উকিল জবাব দেন: ‘এ কেসের ঘটনা কেবল গোরস্থানের নয়। বাড়ির প্রাঙ্গণেও তিনি বহু লোককে কুলখানি-চেহলামের মেজবান খাওয়ান—না-মরেই।’
‘আপনি কী করে জানেন?’
সওয়াল করেন হাকিম। বাদীপক্ষের উকিল জবাব দেন: ‘বাদী নিজেই সেই তেহারি-বিরিয়ানি খাওয়া একজন।’
‘তাহলে তো ব্যাপারটাকে অসামাজিক বলা চলে না। খাওয়ার বেলায় অনৈসলামিক হবে না, মামলার বেলায় হবে; তা তো হতে পারে না।’
পিটিশনে কোনো ক্রিমিন্যাল কন্টেন্ট না পাওয়াতে মহকুমা-ম্যাজিস্ট্রেট মামলাটি খারিজ করে দেন এই বলে যে—এ বিষয়ে ফৌজদারি কোর্টের কিছু করণীয় নেই। রায়ে সংক্ষুব্ধ বোধ করলে বাদী দেওয়ানি আদালতে বিচারপ্রার্থী হতে পারেন।
কিন্তু না-মরে মরণোত্তর অনুষ্ঠানাদির মতো অনৈসলামিক ক্রিয়াকলাপ তো উপেক্ষা করা যায় না। তাই চট্টগ্রাম থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত ধর্মব্যবসায়ীদের মুখে মুখে গুঞ্জিত হতে থাকে—‘এসলাম খাতের মে হ্যায়’। চৌধুরীসাহেব বান্দরবান শহরের আবাসিক হিসেবে দেওয়ানি মোকদ্দমাটা দায়ের হয় বান্দরবান-এসডিওর আদালতে—যেহেতু তিনি ‘চিটাগাং হিলট্র্যাক্ট রেগুলেশন’-এর অধীনে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেশন জজেরও ক্ষমতাধারী। সে সুবাদে তিনি অপরাধী সাব্যস্ত বিবাদীকে সাত বছর পর্যন্ত অশ্রম কারাদণ্ড দিতে অথবা দায়েরায় সোপর্দ করতে পারেন।
কিন্তু বাদীপক্ষের নিয়মিত তদবিরের অভাবে এবং বিবাদীপক্ষের নানামুখী তদবিরের প্রভাবে এ কোর্টেও তারিখের পর তারিখ পড়তে পড়তে ঘনায়মান স্বাধীনতা সংগ্রামের আবহাওয়ায় গুরুত্ব হারিয়ে চৌধুরীসাহেবের বিরুদ্ধে রুজু করা কেসটি একসময় হিমাগারে চলে যায়।
এভাবে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ফতোয়াবাজদের এলাকায় পৌঁছামাত্রই, ‘মোরতাদ’ ঘোষিত হন দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটি। ঘোষণাটা নতুন হাওয়া সঞ্চার করে এবং তা চৌধুরীসাহেবকে তাড়িয়ে নিয়ে ‘নেজামে এসলাম’ পার্টির রাজনীতির খাদ্য বানিয়ে দেয়। পার্টিটির নেতা তখন, মানে উনিশ শ সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান-শাসনের ম্যান্ডেট পেয়ে যাওয়ার পরে, একদলীয় শাসনের যাবতীয় কুফল বাতলে যাচ্ছেন—ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মুসলমানের দেশ থেকে ইসলাম দূর করা ইত্যাদি।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামি শাসনের ব্রতী-কর্মীরা শওকত চৌধুরীর এসব স্বেচ্ছাচারী আচরণকে পাকিস্তানের পাক জমিনে ইসলামের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রদর্শনের উদাহরণ হিসেবে নেয়। তাদের নেতারাও ইস্যুটাকে বড় সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে—দক্ষিণ চট্টগ্রাম অঞ্চলের আওয়ামী লীগের এক বড় ফাইন্যান্সারকে দমন করার। তাঁর পিতা হাশমত চৌধুরী পাকিস্তান গড়ার জন্যে মুক্তহস্তে দান করেছিলেন। শওকত চৌধুরী মুক্ততর হস্তে দান করছেন পাকিস্তান ভাঙার জন্যে।
এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে স্বাধীনতা-সংগ্রামের সার্বিক কাজে অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন শতগুণ বেড়ে যায়। নিজ এলাকার তাৎক্ষণিক প্রয়োজনের অনেকখানি একাই মেটান চৌধুরীসাহেব—বিশেষত মুক্তিযোদ্ধাদের কালুরঘাট মোর্চার মোটামুটি খর্চা। প্রধানত এর জন্যই তিনি হানাদারশক্তির বিশেষ টার্গেট হয়ে যান।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল মোর্চাটির পতন পর্যন্ত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তঘোষিত দক্ষিণ চট্টগ্রাম জেলার জেলাপ্রশাসক হিসেবে সাতকানিয়া থানা সদরকে জেলা সদর বানিয়ে কাজ করার সময় এসডিও-বান্দরবান সেখানকার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হয়েছিলেন।
পাকিস্তানবিরোধী মোরতাদটিকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের ঘোষণা তো ধর্মব্যবসায়ীদের মুখে মুখে ছিলই, তার সঙ্গে প্রাণনাশের হুমকিও যুক্ত হলো মুক্তিযুদ্ধ বেগ পাওয়ার পরে। বান্দরবানের নেতৃস্থানীয় আবাসিক হিসেবে চৌধুরীসাহেব সম্পর্কিত এ সমস্ত খবর সবচেয়ে বেশি পান এসডিও-বান্দরবান, তাঁর ডিআইও-ওয়ান মারফত। ডিস্ট্রিক ইন্টেলিজেন্স অফিসারটি গভীর রাতে এসডিওর বাংলোয় এসে দিনের গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো তাঁর কাছে সরাসরি পেশ করে যান।
এপ্রিলের শেষার্ধেই মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ প্রয়োজনে কোর্টকর্মে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দুটি কারিগরি করতে হয় এসডিও-বান্দরবানকে। তাঁর কোর্টহাজত থেকে রাঙামাটির ডিসির নির্দেশে কয়েকজন পাকিস্তান-লালিত মিজো-নেতা পাঠাতে হয়—ইন্ডিয়ান আর্মির কাছে সারেন্ডারের মাধ্যমে ভারতের আস্থা অর্জনের উদ্দেশ্যে। আর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের জনৈক জাতীয় নেতার অনুরোধে একই হাজত থেকে আরাকানের স্বাধীনতা-সংগ্রামী ‘কারেন’দের আর্মড-ক্যাডার ‘ফররুখিয়া’ গ্রুপের কয়েকজন যোদ্ধানেতাকে ছেড়ে দিতে হয়—বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বার্মা থেকে উন্নত মানের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষিত যোদ্ধা নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে।
দ্বিতীয় কাজটির জন্য চট্টগ্রাম শহর থেকে নিয়ে আসা ছদ্মনামী ‘ফররুখিয়া’ নেতার ফেরার ব্যবস্থা করে সাতকানিয়ার ব্যবসায়ীটি চুনতি যাচ্ছেন চৌধুরীসাহেবের কাছে, আরাকানি যোদ্ধাদের আংশিক খরচ জোগানোর আর্জি নিয়ে। তাঁর গাড়িতে সহমুক্তিযোদ্ধা এসডিওসাহেবও উঠে বসেন—প্রথমত চট্টগ্রাম-ঢাকার বিস্তারিত খবর নিতে, দ্বিতীয়ত আবেগশাসিত চৌধুরীসাহেবকে সাক্ষাতে একটি জরুরি পরামর্শ দিতে। কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে তিনি তখন সেখানে ছিলেন না। জটিল প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ করে একত্র হলে সব কথার শেষে এসডিও বলেন: ‘স্বাধীনতা-সংগ্রামের প্রয়োজন আপনার জীবনের, মরণের নয়। হানাদার বাহিনীর দোসররা আপনার প্রাণনাশ করতে চাইছে বলে আপনিও প্রাণদান করতে চাইবেন, তার তো কোনো মানে হয় না। এক্ষুনি ইন্ডিয়া চলে যান আপনি। মুক্তিযুদ্ধের কাজ ওখানেও আছে।’
‘আমার মতো মানুষও ইন্ডিয়া চলে গেলে এখানে মুক্তিযুদ্ধের উপকরণ জোগাবে কারা? এই যে সাতকানিয়ার ছোটভাইটি এল, সেও তো মুক্তিযুদ্ধের উপাদানের জন্যই। মুক্তিযোদ্ধা তো বাংলাদেশের ঘরে ঘরেই আছে। নেতাও তো বলেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন। তাই আমি আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে হলেও ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার নির্দেশ পালন করে যাব।’
অজ্ঞাতবাসেই ফিরে যান তিনি। এসডিওসাহেব চৌধুরীসাহেবের বাড়িতে ফিরে তাঁর মাকে জানান, যেকোনো প্রয়োজনে বান্দরবানে খবর দিতে এবং জানতে চান—দক্ষিণ চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে উপস্থিত জামাতিদের হাতে ধর্মীয় ইস্যুটা চৌধুরীসাহেব কেন তুলে দিলেন। উত্তরে, ‘বদ্দা’কে দেশত্যাগ করতে বলতে আসা, শওকতসাহেবের শহুরে ছোটবোনটি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এক তথ্য দিলেন। তাঁদের বংশে মৃত্যুপরবর্তী সৎকৃতির মৃত্যুপূর্ববর্তী মহড়ার অনুরূপ একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল দুই পিঁড়ি আগে। দাদির মুখে প্রথম শোনামাত্রই ঘটনাটা সাত-আট বছরের বালক শওকতকে স্পর্শ করেছিল। তার পিতামহ হায়বত চৌধুরী জীবনে অনেক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেলেও, একটি ছিল অননুকরণীয়—তাঁর দুনিয়া থেকে বিদায়পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোর আদর্শ নমুনা দেখিয়ে যাওয়া।
অতঃপর দাদির সঙ্গে নাতির গল্পের বিষয় এই একটিতেই এসে দাঁড়িয়েছিল। নাতি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এটা-সেটা প্রশ্ন করে, দাদিও ধৈর্য ধরে উত্তর দেন: ‘দাদার বামপাশের কবরটি কার, দাদিমা?’
‘তোমার ছোটদাদির। তিনি তোমার দাদার আগেই ইন্তেকাল করেছিলেন।’
‘দেয়ালের মধ্যে তোমার কবরের জায়গা নেই কেন?’
‘আমি বলে দিয়েছিলাম, ওই জিন্দাকবরে আমার দাফন যেন না-হয়।’
‘কেন?’
‘দাদিমা কবরেও সতিনের ঘরে থাকতে চান না।’
শওকতের মুখরা বড়বুর ফোড়নের জবাবে হেসে উঠে দাদি কৌতূহলী নাতির মনে সত্যের বীজটি তখনি পুঁতে দেওয়া জরুরি ভেবে বললেন: ‘আমাদের ধর্মে মরণের আগে দাফনের ব্যবস্থা নাজায়েজ।’
কিন্তু বালক শওকতের মনে তখন ধর্মের ভাব ছিল না, ছিল বরং রূপকথার প্রভাব। তাই দাদার অমন করে দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার গল্পটা রূপকথার মতো রোমাঞ্চকর বোধ হয়েছিল তার, যা মনের গভীরে এঁকেছিল একটা চিরস্থায়ী ছবি। ছবিটি পরে বয়ঃসন্ধিকালীন সংবেদনশীল মনে সুন্দর এক স্বর্গীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং নিজের জীবনের শেষ অধ্যায়ে এলাকার কিংবদন্তিপ্রতিম পিতামহকে অনুসরণের প্রেরণা জাগায়। বিষয়টি নিয়ে ভাবতে ভাবতে এসডিওসাহেবের মনে পড়ে যায় মানবজীবনের অন্তর্ভেদী ভাষ্যকার ইউজিন ইউনেস্কোর নাট্যকলার সারকথাটি—‘মানবজীবন এক সকরুণ প্রহসন’।
কিন্তু জুলাই মাস থেকেই যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন চৌধুরীসাহেব। প্রথম দিকে জনশ্রুতিতে মনে হচ্ছিল হানাদার সরকারের দাসানুদাস রাজাকার, আলবদর, আলমুজাহিদ ইত্যাদি বাহিনীর নিরন্তর তাড়া খেয়ে শওকত চৌধুরী চুনতি এলাকার বনাঞ্চল থেকে পিছু হটতে হটতে গভীর জঙ্গলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন বলেই আপাতত যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন আছেন—পরিস্থিতি উন্নত হওয়ামাত্রই লোকালয়ে ফিরে আসবেন।
কিন্তু তার বদলে আগস্টের শুরুতে চাউর হলো যে শেষ পর্যন্ত ভারতে চলে যেতেই বাধ্য হয়েছেন চৌধুরীসাহেব। কারণ তাঁর মতো চিহ্নিত শত্রুগুলোকে ধরার জন্য পাক-সরকার লোভের সকল রকমের টোপই ফেলেছেন চতুর্দিকে। পরপরই খবর হলো, মেঘালয়ে যেতে তিনি পারেননি। অন্তরায় ছিল মাঝখানে বিশাল রাইনখং রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকার পাকিস্তান-পালিত ভারতবিরোধী মিজোবাহিনী। আগস্টের শেষদিকে লোকমুখে নতুন খবর ছড়াল যে চৌধুরীসাহেব তুম্বরু-গুন্দুং হয়ে বার্মায় ঢুকতেও ব্যর্থ হয়েছেন, সে দেশের সরকার বর্ডার সিল করে দিয়েছিল—যাতে সেখানে বাংলাদেশ থেকে কোনো রিফিউজি ঢুকতে না পারে।
অতঃপর সেপ্টেম্বরের শুরুতেই সমগ্র দক্ষিণ চট্টগ্রামজুড়ে ভয়ংকর এক দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে চৌধুরীসাহেবকে ইদানীং চট্টগ্রাম শহরেই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরিষ্কার চেনা যাচ্ছে না বলে কেউ শনাক্ত করছে তো কেউ শনাক্তি নাকচ করছে। এতে নানারকম প্রশ্ন উঠছে। এমন সুন্দর চেহরাসুরত এবং লম্বাচওড়া গড়নের বিশিষ্ট একজন মানুষকে একনজরে চেনা যাচ্ছে না মানেটা কী?
যারা দেখেছে তারা বলে—নিঃসন্দেহে চেনা যাবে কী করে? শওকত চৌধুরীকে কি কেউ কখনো ন্যাড়া মাথায় দেখেছে? খালি গায়ে দেখেছে? নেংটি-পরা দেখেছে? মোট-মাথায় দেখেছে? ভারবহনে অনভ্যস্ত মানুষটি বস্তার ভারে বসে পড়লে, রাজাকাররা বেত মেরেও ওঠাতে না পেরে দুপাশ থেকে দুজনে দুকান ধরে টেনে তুলছে—এমন দৃশ্য চোখে দেখার পরে কেউ কি নিশ্চিত হতে পারে যে চরম লাঞ্ছিত এ মানুষটি চৌধুরীসাহেবই?
কথাটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল যে হানাদার সরকার ধরা পড়া স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের বন্দরের কুলি বানিয়ে ওজনদার মোট বইয়ে চট্টগ্রাম পোর্টের মাল খালাস করে ট্রাকে ট্রাকে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে সাপ্লাই দিচ্ছে, তাঁদেরই ট্রাকের মজুর হিসেবেও ব্যবহার করে। এটা করা হচ্ছে যাতে পাকিস্তানবিরোধীদের এ পরিণতি বাংলাদেশের জনসাধারণ স্বচক্ষে দেখে নিজেদের শোধরায়।
অবশেষে একদিন চৌধুরীসাহেবকে নির্ভুল চিনতে পেরেছে চুনতির বাড়ির পাশের তাঁরই এক কর্মচারী। ষোলশহর রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকটির পাশের রিকশাটি থেকে দেখে চমকে উঠে রিকশার ওপর দাঁড়িয়ে সে আগে-পিছে অপেক্ষমাণ গাড়ির লাইনটির দৈর্ঘ্য দেখার ভান করে তাঁর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেই ইশারায় বারণ করে চৌধুরীসাহেব যথাসম্ভব নিম্নকণ্ঠে কেবল একটি বাক্য উচ্চারণ করেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বিপরীত দিকে: ‘তুঁই বা-জি ইক্কিনি আঁর মার মিক্কা খেয়াল রাখিবা।’
মাকে দেখতে গেলে ছেলের হূদয়বিদারক খবর শুনে বৃদ্ধা চৌধুরানী কর্মচারীটিকে সঙ্গে নিয়েই চুনতি থেকে বান্দরবানের এসডিওর বাংলায় ছুটে এসে তাঁকে বললেন: ‘ওয়া বা-জি, তুঁই তো সরকারের মানষ, আঁর ফোয়াগোয়ারে যে-কোনোমতে তোঁয়ার তে ছুডাই দন ফরিবো।’
এসডিওর একটা ভালো সোর্স ছিল আলীকদম এলাকার শক্তিশালী এক পাঞ্জাবি ভূমিদস্যু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সৈনিক মেজর হাফিজ যুদ্ধের শেষ অবস্থান চিরিঙ্গা থেকে লামা থানায় ঢুকে এলাকাটিতে রয়ে যান পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জমির লোভে। পাঞ্জাবিটিকে ডেকে এনে চৌধুরীসাহেবের মায়ের ফরিয়াদটি জানিয়ে দিলেন এসডিওসাহেব, তাঁর ব্যক্তিগত অনুরোধসহ। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এলাকার সর্বেসর্বা হয়ে ওঠা লোকটা কয়েক দিন পরে এসে তার চেষ্টার দীর্ঘ এক ফিরিস্তি দিয়ে জানিয়ে গেল যে এহেন বর্বর কর্মের অভিযোগ যে পাক-সরকারের বিরুদ্ধে একটা উসকানিমূলক অপপ্রচার, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়ে এসেছে।
নির্জলা মিথ্যা হলেও, ক্ষমতাশালী মেজর হাফিজের ব্যক্তিগত তদন্ত প্রতিবেদনটিকে সত্য গণ্য করে শওকত চৌধুরীর মা সান্ত্বনা পেতে পারেন ভেবে খবরটি তাঁকে জানানোর জন্য এসডিওসাহেব নিজের ব্যক্তিগত আর্দালিটিকেই চুনতি পাঠালেন। কিন্তু ছেলের ব্যাপারে মায়ের মনের ভেতরের খবরই সত্যতর জ্ঞান করলেন চৌধুরীসাহেবের মা। তিনি একটি মশারি নিয়ে এসে এসডিওসাহেবের হাতে দিয়ে বললেন: ‘ওয়া বা-জি, তুঁই আঁর ফোয়ারে ছুডাইর ন-ফাইরলে, আল্লার ওয়াস্তে এই মশারিগান ইতার কাছে ইক্কিনি ফোঁওসাই দ। আঁর ফোয়ারে তো মশায় খাইয়ারে শ্যাষ গরি ফালার।’
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলেন এসডিও। ভেঙেই পড়তেন তিনি, মায়ের চোখ বোরকা-ঢাকা না থাকলে। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে মা অবশেষে চলে গেলেন, তাঁর শেষকথাটি বলে: ‘আঁরা তো ফুন্নি, বান্দরবানের রাজা মং শোয়ে প্রু চদরি তোঁয়ার জান বাঁচাইয়ে। তার ফোঁয়ারে তুঁইও বৌত্ মুক্তিযুদ্দার জান বাঁচাইয়ো আস্তা মরণের দুয়ারের তুন্। তোঁয়ারা দুইজনে মিলিয়ারে যদি আঁর ফোয়াগোয়ারে বাঁচাইন্ ন ফারঅ, তোইলে ইতার মরা লাশ্শুয়া ইক্কিনি আঁরে আনি দ—যাতে তারে কবরত্ শোয়াই দিইয়ারে আঁই গরত্ যাইত্গই ফারি।’
তিনি নাকি সারা দিন ছেলের কবরের পাশে জায়নামাজের ওপরেই শুয়ে-বসে থাকেন।
এসডিওসাহেবও একে-ওকে জিজ্ঞেস করতে থাকেন চৌধুরীসাহেবের খবর। ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ঢাকায় দাসখত সই করার পরে তিনি বদলি হয়ে চট্টগ্রামে এসে একরকমের খবর পান বেঁচে যাওয়া এক সিনিয়র অফিসারের কাছে—রোগে-শোকে-অনাহারে-অনিদ্রায় লেবারের কাজের অযোগ্য হয়ে যাওয়া মুমূর্ষু মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে নিজেদের কবর ক্ষুদিয়ে নিয়ে গুলি করে ফেলে দিত হানাদার বাহিনী, আর ‘মুক্তি’দের সেই গণকবরে মাটিচাপা দিত রাজাকার বাহিনী।
নান্দনিক কবরকামী চৌধুরীসাহেবের অমন অমানবিক কবরগামী হওয়ার কথা ভাবা যায় না বিধায়, এসডিওসাহেব এখনো ভাবেন—তাঁর সহমুক্তিযোদ্ধা শওকত চৌধুরীদের খুঁজে না পেলেও তাঁদের ঘাতকদের খুঁজে বের করে তাদের পাপের শাস্তিবিধান না করা পর্যন্ত বাঙালি জাতির শাপমোচন হবে না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০
Leave a Reply