লেখা-অলেখার ভিড়ে একটি হিসেবে নেওয়া বই
হাসান আজিজুল হক
পিকাসোর রঙ, মাইকেলাঞ্জেলোর হাতুড়ি—বরেন চক্রবর্তী \ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ \ অন্যপ্রকাশ, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: মাসুম রহমান \ ৪৫৬ পৃষ্ঠা \ ৫৫০ টাকা
ডাক্তার বরেন চক্রবর্তী তীব্র কণ্ঠে কথা বলেন আর নরম চোখে তাকান তাঁর রোগীদের দিকে। অতিথি-অভ্যাগতের সঙ্গেও তাই। প্রবল কণ্ঠ, নরম চাউনি। যাঁরাই তাঁর কাছে যান বালাই নিয়ে, তিনি তাঁদের সহায়। এ বছর তাঁর একটি চমৎকার বই বেরিয়েছে। ৪৫৬ পৃষ্ঠার বিশাল বই, নাম পিকাসোর রঙ, মাইকেলাঞ্জেলোর হাতুড়ি। নামটা চমৎকার। আন্দাজ হয়, নিশ্চয় ভাস্কর্য পেইন্টিং ইত্যাদি বিষয়ে এ বই। সে কথাটায় একটু পরে আসছি। তার আগে বলে নিই, বরেন একজন রীতিমতো পরিচিত লেখক। জানি, এ কথা বললেই বরেন তাঁর স্বাভাবিক তীক্ষ কণ্ঠে আপত্তি জানাবেন যে তিনি সামান্য একজন ডাক্তারমাত্র, কিছুতেই লেখক-টেখক নন।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর বইগুলো কয়জন পাঠক দেখেছেন বা পড়েছেন, তা আমি বলতে পারব না। তবে এটা বলতে হবে, এত দিনে তাঁর বইয়ের সংখ্যা ইংরেজি-বাংলায় ডজনখানেক ছাড়িয়েছে। আমি অবশ্য গুণে দেখিনি। তাঁর লেখা খুবই ঝরঝরে। একটা নিয়ত প্রবাহ আছে, সেটা চলতেই থাকে, হোঁচট খেতে হয় না। বইটির নাম দেখে মনে হতেই পারে যে বরেন বোধহয় একজন জাঁদরেল কলাসমালোচক, সমঝদার শিল্পবোদ্ধা। কিন্তু কথা ঠিক তা নয়।
মনে হবে বইটি একটি ভ্রমণকাহিনি। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সঙ্গে নিয়ে বেড়ানোর গল্প। শখ আর শৌখিনতার মধ্যেই পড়ে বিষয়টা। বরেন পর্যটক নন। একসময় যাঁদের বলা যেত ‘গ্লোব ট্রটার’, তিনি সে দলে নন। পাখির মুক্তিতে হিল্লি-দিল্লি ঘুরে বেড়ানো। কোথায় যাননি, কোথায় যাচ্ছেন না তিনি? মহাদেশ থেকে মহাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পিকাসোর রঙ, মাইকেলাঞ্জেলোর হাতুড়ি বইটিতে দেখছি শুরু অস্ট্রেলিয়া থেকে। সুলুক-সন্ধানের মতলব খুঁজছেন, যেতে হবে সিডনি থেকে মেলবোর্ন। একমাত্র তিনিই শুধু শুনতে পান এক অনিবার্য আহ্বান, দেখতে পান নিঃশব্দ হাতছানি। রঙের জগৎ, আকারের জগৎ, অবয়বের জগৎ থেকে সুদূর সময়ের মহাশিল্পীদের ঈশ্বরের প্রতিস্পর্ধী সৃষ্টির বিশ্ব থেকে। তাঁর ভ্রমণের উদ্দেশ্য খুবই নির্দিষ্ট, আর এর জন্য নিজেকে তিনি তৈরি করেছেন তিল তিল করে। শিল্পকলার ইতিহাস পড়েছেন, হাজার হাজার বছরের শিল্পকীর্তি, ভাস্কর্য স্থাপত্য নিয়ে বহু খোঁজ-খবর করেছেন পণ্ডিত হওয়ার জন্য নয়, আর্ট সমঝদার হিসেবে নয়, আত্মপ্রকাশের জন্য নয়। আত্মবিকাশের জন্য হলেও হতে পারে, তবে সেটাও মুখ্য নয়। শুধুই আস্বাদনের জন্য। এ কারণেই তাঁর ভ্রমণ পরিকল্পনা মোটেই অগোছাল এলোমেলো নয়, খুবই সংহত, নির্দিষ্ট এবং স্থিরসংকল্পসিদ্ধ।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি গেছেন, মূল লক্ষ্য কিন্তু মেলবোর্ন। সেখানকার ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারি অব ভিক্টোরিয়া। তখন সেখানে পিকাসোর ‘উইপিং উইমেন’ আছে। অত বড় বিখ্যাত আর্ট গ্যালারি, বিশ্বখ্যাত শিল্পকর্ম সেখানে তো কম নেই! তবু লক্ষ্য শুধু একটিতেই একাগ্র: ১৯৩৭ সালে আঁকা পিকাসোর উইপিং উইমেন। এ সূত্রেই হুড় হুড় করে এসে পড়ল পিকাসোর আরেক সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম ‘গোয়ের্নিকা’র কথা। এখানেই বলে নিলেন এ ছবির ইতিহাস, পটভূমি, ছবির প্রত্যক্ষ খুঁটিনাটি বিবরণ আর সেই সঙ্গে পিকাসোর জীবনকথা। ‘গোয়ের্নিকা’ এ গ্যালারিতে নেই, তবে দেখা তো আছে। কাজেই বলার কথাগুলো বলেই নিলেন। কী জানি, আবার কখন এ প্রসঙ্গ আসে কি না আসে। উইপিং উইমেন দেখার পর বরেন কি গ্যালারির অন্য শিল্পকর্মগুলো দেখলেন না? তা কী করে হবে? দেখতে চাইলেন ভ্যান গগের হেড অব এ ম্যান, সেটা নিয়ে তখন বিতর্ক চলছে, দেখা হলো না। দেখলেন টিসিয়ান, মাতিস, ক্লদ মনে, অগস্ট রেঁনর, পল রুবেন, রেমব্রান্ট। এথেন্সে গিয়ে তিনি দেখবেন প্রত্নমিউজিয়াম। সেখানে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিক ভাস্করদের শত শত ভাস্কর্য। খোলা আকাশের নিচেও আছে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের ভাস্কর প্রাক্সিটেলাসের ভাস্কর্য: আগামেমনন, পসেইডন, আফ্রোদিতি (বহু ভাস্করের তৈরি একই মূর্তি)। এসব দেখা হয়ে গেলে খুঁজে বেড়াচ্ছেন সক্রেটিসের কারাগারটিকে। বহু খোঁজাখুঁজির পর এক গ্রিক যুবতীর কাছ থেকে জানা গেল ‘সকাতিস’-এর কারাগার রয়েছে ওই ওইখানে, পাহাড়ের পাদদেশে। দাঁড়ালেন সেখানে গিয়ে, একবার বলে নিলেন সক্রেটিসের জীবনকথা, খানিকটা দর্শনের কথাও বাদ গেল না। জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় কেটে তৈরি সক্রেটিসের কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে রোমহর্ষ হয় বরেনের।
বলাই বাহুল্য, ডাক্তার প্রায় সব মহাদেশের বড়ো বড়ো মিউজিয়ামের একটিও দেখা বাকি রাখেননি। রোম আছে, ফ্লোরেন্সের উফিজি আছে, লন্ডনের সব গ্যালারি, প্যারিসের ল্যুভ্সহ প্রতিটি গ্যালারি, আমেরিকার নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, জার্মানির মিউনিখ, হ্যানোভার, স্পেন বার্সেলোনাসহ পৃথিবীর পুব-দক্ষিণের দেশ জাপান, হংকং, বেইজিং, মালয়েশিয়া, বালি, ভারত। বাকি তিনি কিছুই রাখেননি। দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর থেকে একাল পর্যন্ত শিল্পপথ পরিভ্রমণ করেছেন। তবু এ বই পণ্ডিতের লেখা নয়, বিশেষজ্ঞের নয়, এ এক মার্জিত রুচিসম্পন্ন রসপিপাসু ভোক্তার একান্তই স্বাধীন রচনা, তবে বইটি পড়ে অনেকেই ফাঁকা-পণ্ডিত, ফাঁকা-গবেষক, ফাঁকা-শিল্পবেত্তা সাজার চেষ্টা করলেও করতে পারেন।
সবশেষে বলব, একটি ভীষণ অভাব আর আক্ষেপের কথা। যে সাধারণ কাগজে বইটি ছাপা হয়েছে, সেই কাগজেই সাদা-কালোয় ছাপা হয়েছে শিল্পকর্মগুলো। চিন্তা করা যায় দা ভিঞ্চি, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, বত্তিচেলি এঁদের মহান সৃষ্টিগুলো সাদা-কালোয় ছাপা হয়েছে! এতে এ গ্রন্থটির কত যে ক্ষতি হয়েছে, আমি তা পরিমাপ করতে পারি না। এর পুরো দায়িত্ব বরেনের নয়। ‘অন্য প্রকাশ’ তো দেশের একটি নামকরা প্রকাশনা সংস্থা! আমি আশা করব, পরের সংস্করণে (এ বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোতে দেরি হবে না বলেই মনে করি) দামি আর্ট পেপারে প্রতিটি শিল্পকর্মের জন্য বরাদ্দ থাকবে পুরো একটি করে পৃষ্ঠা। উল্টো পৃষ্ঠা সাদাই থাকবে, প্রতিটি ছবিতে পৃষ্ঠার সংখ্যা এবং চিত্রকর্মের তালিকাভিত্তিক নম্বর দেওয়া উচিত আর যত্ন করে দিতে হবে একটি নির্ঘণ্ট, যাতে বইয়ের মধ্যে যে-কোনো ছবি সঙ্গে সঙ্গে বের করা যায়।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০
Leave a Reply