২৫ জুন প্রথম আলোর ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে, ‘পলাশী-পরিক্রমা’য় সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ইংরেজ অনুকরণে অচিরেই বাঙালিদের অনেকে নিজেদের হীন গণ্য করতে শুরু করল। ইয়ং বেঙ্গলরা যেমন, যা কিছু বঙ্গসংস্কৃতির, সেসব তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভরে বর্জন করাই তাদের আধুনিকতা।’
যেসব বাঙালি নিজেদের হীন গণ্য করত, তারা কারা, লেখক তা উল্লেখ করেননি। কিন্তু পরবর্তী বাক্যে তিনি ইয়ং বেঙ্গলদের উদাহরণ দিয়েছেন। তাতে ধরে নেওয়া যায়, ইয়ং বেঙ্গলরা নিজেদের হীন গণ্য করতেন। ইয়ং বেঙ্গলরা কখন, কোথায়, কীভাবে নিজেদের হীন গণ্য করেছেন?
লেখকের মতে, ইয়ং বেঙ্গলরা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতেন ‘বঙ্গ-সংস্কৃতির সবকিছুকে।’ এটা সঠিক নয়।
ইয়ং বেঙ্গল কারা? ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দে হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (জন্ম ১৮০৯) মাত্র ১৭ বছর বয়সে ওই কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ‘ডিরোজিও হিন্দু কলেজে পদার্পণ করিয়া চুম্বক যেমন লৌহকে টানে, সেইরূপ কলেজের সকল শ্রেণীর বালককে আকৃষ্ট করিয়া লইলেন।’ [শিবনাথ শাস্ত্রী—রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজ] এই ছাত্ররা হলেন: রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রাধানাথ শিকদার, প্যাঁরীচাদ মিত্র, রামতনু লাহিড়ী, সারদাপ্রসাদ ঘোষ, কালীপ্রসাদ ঘোষ, কৃষ্ণধন মিত্র প্রমুখ। ডিরোজিওর এই ছাত্রদের ইয়ং বেঙ্গল বলা হয়।
ডিরোজিওর সংস্পর্শে এসে ইয়ং বেঙ্গলরা ইউরোপের সমস্ত জ্ঞানভান্ডার আত্মসাৎ করেন। তাঁরা সর্বদাই পড়াশোনা করতেন, আলোচনা করতেন, বিতর্ক করতেন এবং নতুন চিন্তায় উজ্জীবিত হতেন। অপরিসীম কৌতূহল আর প্রচণ্ড জ্ঞানতৃষ্ণা তাঁদের সত্য-অনুসন্ধানী করে তুলেছিল, যদিও তাঁদের বয়স গড়ে ১৪ থেকে ১৮, তাঁরা জ্ঞানীর মতো কথা বলতেন এবং পণ্ডিতের মতো তর্ক করতেন। তাঁদের সেসব বিতর্ক উপভোগ করতে অনেক জ্ঞানী ব্যক্তি আসতেন, আসতেন ইয়ং বেঙ্গলের বিরোধী ব্যক্তিরাও। তাঁদের এ লোভনীয় বক্তৃতা শুনতে নিয়মিত উপস্থিত হতেন তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এডওয়ার্ড রায়ান, ডেপুটি গভর্নর বার্ড সাহেব, লর্ড উইলিয়াম বেন্টিকের ব্যক্তিগত সচিব কর্নেল বেনসন, বিশপ কলেজের অধ্যক্ষ ড. সিনা প্রমুখ। এসব বিতর্ক-আলোচনায় তাঁরা যে বঙ্গসংস্কৃতিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছেন, তার কোনো প্রমাণ নেই।
ইয়ং বেঙ্গলদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কী ছিল, তা আলেকজান্ডার ডাফের মুখে শোনা যাক: ‘দেয়ার থিওরি ওয়াজ, দ্যাট, আ প্রফেসিং ইনকোয়ারিজ আফটার ট্রুথ।’ [আলেকজান্ডার ডাফ—ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া মিশনস] অর্থাৎ, ইয়ং বেঙ্গলদের চিন্তা ছিল সত্য অনুসন্ধান করা, নিজেকে হীন ভাবা নয়।
ইয়ং বেঙ্গলদের চরিত্র সম্পর্কে এডোয়ার্ড টমাস বলেন, ‘ইনডেড, দ্য কলেজবয় ওয়াজ আ সিনোনিম ফর ট্রুথ।’ [এডোয়ার্ড টমাস—লাইফ অব ডিরোজিও] অর্থাৎ, বাস্তবিকই ইয়ং বেঙ্গল মানেই সত্যবাদী।
বালক রসিককৃষ্ণ আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়েছেন। সাক্ষীকে গঙ্গাজল-তামা-তুলসী স্পর্শ করে শপথ নিতে হয়। রসিককৃষ্ণ বলছেন, ‘আমি গঙ্গাজল মানিনে।’ এ কথার অর্থ, গঙ্গাজল মানবজীবনের চরম ভাগ্যনিয়ন্ত্রক, এটা রসিককৃষ্ণ মনে করেন না।
ইয়ং বেঙ্গলদের দর্শন বুঝতে চেষ্টা করলে দেখা যাবে, তাঁরা হিন্দুধর্মকে আঘাত করেননি, জিজ্ঞাসা করেছেন; কিছু অযৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন। তাঁরা ধর্মের নৈতিকতার মধ্যে লোক-বিশ্বাস আছে বলে সন্দেহ করেছেন।
নৈতিকতায় কী কী লোক-বিশ্বাস জড়িত আছে? ১. শনিবার যাত্রা অনুচিত; ২. ওলা ওঠায় শীতলা পূজা দেওয়া উচিত; ৩. নিচু জাতির সংসর্গ বর্জন করা উচিত; ৪. শাস্ত্রবচন মাত্রই মান্য করা উচিত; ৫. মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া উচিত। যুক্তিহীন শাস্ত্রবচন, ক্ষতিকর লোক-বিশ্বাস আর ধর্মীয় গোঁড়ামি কি বঙ্গসংস্কৃতির অংশ?
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শোষণ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম ইয়ং বেঙ্গলরাই সোচ্চার হয়। ইংরেজ ভারতবর্ষকে বলছে অসভ্য, বর্বর। প্রতিবাদে ইয়ং বেঙ্গল বলছে, ‘কোন অধিকারবলে ইংরেজরা এ দেশকে বর্বর ও অসভ্য বলে? শুধু ইংরেজদের এ দেশ জয় করার আগে থেকে নয়, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষ ছিল শিল্পসমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী একটি দেশ। আমেরিকা যেমন দাসত্বের শিকল ছিঁড়ে আজ উন্নত একটি দেশ, ভারতবাসীও তার পরাধীনতার বন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই এ দেশের চিত্তমুক্তি ও শ্বাসমুক্তি ঘটবে এবং সমস্ত গ্লানি ও দুর্গতির অপনোদন হবে।’ [ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল, ফেব্রুয়ারি, ১৮৩১]
জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার সম্পাদক রসিককৃষ্ণ মল্লিক ইংরেজ শাসনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলকাতার টাউন হলের এক প্রতিবাদ সভায় (৫ জানুয়ারি, ১৮৩৫) বলেন, ‘গরিব ভারতবাসীর কষ্টার্জিত অর্থ কেন কেড়ে নেওয়া হবে? তারা নিরন্ন ও অর্ধ উলঙ্গ থাকবে, আর বিদেশি শাসনের ও বিজাতীয় ধর্মের সাহায্য কীর্তনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা অপচয় করা হবে কেন?’ [বেঙ্গল হরকরা, ক্রোড়পত্র, কলকাতা, ৬ জানুয়ারি, ১৮৩৫]। ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৬ বছরের ছাত্র কৈলাশচন্দ্র লেখেন, ‘শতবর্ষ পরে তোমার কল্পনার ভারতবর্ষ।’ এতে তিনি বলেন, মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য একদিন তরুণ বাঙালি নেতা জল্লাদের হাতে প্রাণ দেবে। [ক্যালকাটা লিটারেরি গেজেট, ৬ জুন, ১৮৩৫] সারদাপ্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপ ১৮৪১ সালে গড়ে তোলে আধা রাজনৈতিক সংগঠন ‘দেশ হিতৈষণী সভা’। এর মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করা। (ক্যালকাটা মান্থলি জার্নাল, নভেম্বর ১৮৪১)
শুভ রায়
শুক্রাবাদ, ঢাকা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০
Leave a Reply