সম্প্রতি বেরিয়েছে বাংলাদেশের প্রবীণ কবি আবুল হোসেনের কবিতা সংগ্রহ। এই সংকলন নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন জাফর আহমদ রাশেদ
জাফর আহমদ রাশেদ: আপনার বইয়ের ফ্ল্যাপে, ছবির নিচে আছে, ‘আমাদের প্রবীণতম কবি তিনি। হয়তো নবীনতমও, কে বলতে পারে!’ আপনার কী মনে হয় নিজেকে?
আবুল হোসেন: কথাটা প্রকাশকের। সম্পাদকেরও কি না জানি না। ফ্ল্যাপে সাধারণত প্রকাশকের মতামতই থাকে। নবীনতম থাকতে তো ইচ্ছাই হয়। কিন্তু বয়সকে ভুলে থাকা অসম্ভব। আমি নিজে নবীন থাকার চেষ্টা করেছি। তবে, কালের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সহজ নয়। কতটা নবীন থাকতে পেরেছি সেটা আমার মুখ থেকে না শুনে আমার পাঠকদের কাছে শুনলে ভালো হয়। সারা জীবন নবীন থাকার চেষ্টাই করে এসেছি, শারীরিকভাবেই নয়, মানসিকরূপে।
রাশেদ: সম্প্রতি বেরিয়েছে আপনার এই কবিতা সংগ্রহ। ইতিমধ্যে লেখা সব কবিতাই কি এই সংকলনে আছে?
আবুল হোসেন: সব কবিতা এই বইয়ে নেই। আমি তো এখনো লিখে যাচ্ছি। সুতরাং আমার সব কবিতা এই বইয়ে থাকতে পারে না। তার চেয়ে বড় কথা, আমার অনেক কবিতাই, বিশেষ করে চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখা অনেক কবিতা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। আমার কাছে কোনো কপি নেই। পাণ্ডুলিপি তো নেই-ই। মুদ্রিত কবিতাগুলোও সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। সে কবিতাগুলো সংগ্রহ করা গেলে, আমার এ বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। তবে ৯০ শতাংশ কবিতাই এই বইয়ে আছে। সুতরাং এটাকে প্রতিনিধিস্থানীয় বলা যাবে।
রাশেদ: এই বইয়ের আপনার কবিতার বেশির ভাগ ধরা থাকল। বইটা বা আপনার সমগ্র সৃষ্টিকর্ম একসঙ্গে দেখে এর লেখক হিসেবে আপনার কী মনে হচ্ছে?
আবুল হোসেন: আমি যখন মাঝেমধ্যে এই কবিতাগুলোর কথা ভাবি, তখন অবাক হই, কী করে এগুলো লিখলাম! আমাকে যদি এর কবিতাগুলো আবার লিখতে বলা হয়, আমি লিখতে পারব না। যতক্ষণ আমার পছন্দ না হচ্ছে ততক্ষণ ওই কবিতা আমি ছাপতে দিই না। তার মানে এখানে কবিতাগুলো ছাপা হয়েছে আমার পছন্দেই। পছন্দের বাইরে কোনো কবিতা নেই।
রাশেদ: সেই ১৯৪০-এ বেরিয়েছে আপনার প্রথম বই ‘নববসন্ত’। তখনই আপনি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। সেই সময়টা নিয়ে বলুন।
আবুল হোসেন: চল্লিশে যখন নববসন্ত বের হলো, তখন সময়টা ছিল বাংলা কবিতার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন শুধু নয়, আমি বলব তখনো দুই হাতে লিখে যাচ্ছেন। তিরিশের প্রধান কবিরাও, যাঁরা আধুনিক কবিতার পথপ্রদর্শক—জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন—সচল রয়েছেন। অবাক হতে হয় ভেবে, সেই সময়ে আমাদের মুসলমান সমাজের কবিরা কেউ এই আধুনিক কবিতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। যেমন হুমায়ুন কবির, আবদুল কাদির, মহীউদ্দীন, সুফিয়া কামাল—এঁরা তখন লিখে যাচ্ছেন। কিন্তু সে ভিন্ন ধরনের কবিতা। একটা কথা খুবই প্রচলিত যে আধুনিক বাংলা কবিতার প্রবর্তক যাঁরা, তাঁরা সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত। বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন, শিক্ষক ছিলেন। হুমায়ুন কবির ছিলেন তাঁদের বন্ধু। তিনি ছিলেন অসাধারণ ছাত্র, অসাধারণ অধ্যাপক। অবাক হতে হয়, তিনিও আধুনিক কবিতার সঙ্গে যুক্ত হলেন না। আমাদের সমাজের দুই প্রধান কবি নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীন—তাঁরাও তাঁদের মতো করে লিখে গেলেন। আধুনিক কবিতার যে আন্দোলন, তার সঙ্গে যুক্ত হলেন না। বিষয়টা আমাকে বিস্মিত করে।
আমি এই আধুনিক কবিতার সঙ্গে যুক্ত হলাম—এটাকে বিস্ময়ের বিষয় মনে হতে পারে। প্রেসিডেন্সি কলেজে যাঁরা আমার শিক্ষক ছিলেন, বিশেষ করে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের লেখক, তাঁরা কেউ আধুনিক কবিতার পক্ষপাতি ছিলেন না। তাঁরা রবীন্দ্রনাথকেই বাংলা কবিতার পরাকাষ্ঠা মনে করতেন। অথচ বাংলা আধুনিক কবিতা তো রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই সৃষ্টি।
আমি যখন লেখা শুরু করি আমার চোখের সম্মুখে ছিলেন আধুনিক কবিতার প্রবর্তকেরা। মুসলমান কবিরা তো ছিলেনই। আমি আধুনিক কবিতাকেই বেছে নিই। ছেলেবেলায় কিছুদিন লেখার পরই আমার মনে হয়েছিল, আমি যদি ভিন্ন কিছু লিখতে না পারি, তাহলে কবিসমাজে আমার কোনো জায়গা হবে না। এই ভিন্নভাবে লিখতে গিয়েই আমি আধুনিক কবিতার সঙ্গে, সেই প্রথম থেকেই যুক্ত হয়ে পড়ি।
রাশেদ: ৭০ বছর ধরে কবিতা লিখছেন। এর মধ্যে কি কখনো ছেদ পড়েছে?
আবুল হোসেন: আমি মোটামুটি সারা জীবনই লিখেছি। ’৪০-এ নববসন্ত, প্রথম বই। পরের বই প্রায় ৩০ বছর পরে। তাতে মনে হতে পারে এর মাঝখানে কোনো না কোনো সময় আমার লেখা থেমে ছিল। আসলে তা নয়। নানা কারণে দ্বিতীয় বই ছাপতে দেরি হয়েছে। কিন্তু আমি বিরতিহীনভাবেই কবিতা লিখে গেছি। এর মধ্যে কোনো ছেদ নেই।
রাশেদ: আপনার কবিতায় আবেগকে চাপা দেওয়ার একটা ব্যাপার আছে। সমালোচকের মতে, আপাতদৃষ্টিতে আপনার কোনো কোনো কবিতাকে শুধু নির্মেদই মনে হয় না, নিরুত্তাপও মনে হয়। এই ভঙ্গিটার প্রতি পক্ষপাত কেন?
আবুল হোসেন: আমার কবিতায় আবেগ কম আমি মনে করি না। যেটা নেই সেটা হলো ভাবালুতা। আবেগ ছাড়া তো কবিতা হয় না। আমি যদি কবিতা লিখে থাকি, তাতে আবেগ নেই, আমি মনে করি না। ইংরেজি কবিতা পড়তে গিয়ে আমার সব সময় মনে হয়েছে, বাংলা কবিতায় ভাবাবেগটা বড় বেশি। যেখানে সামান্য কথাতেই মনের কথা বলা যায়, আবেগ ব্যক্ত করা যায়, সেখানে আমরা বড় বেশি কথা বলি। রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও এই আবেগের বাড়াবাড়ি দেখি। আমার মনে হয়েছিল, কত কম কথা বলে কত বেশি কথা বলা যায়—সেটাই আমার আদর্শ।
রাশেদ: লিখেছেন, ‘এক একটি শব্দ, চরণ, কবিতা বহুদিন ধরে মনে মনে ভাবি, আওড়াই। কখনো কখনো কাগজের পাতায় লিখবার পূর্বেই প্রায় সমস্ত কবিতাটি মনে মনে লেখা হয়ে যায়।’
আবুল হোসেন: আমার কবিতা সাধারণত এভাবেই তৈরি হয়। আমি একেকটা কবিতা বহুবার লিখি। শব্দ পরিবর্তন করেই যাই। যতক্ষণ না তা আমার পছন্দ হয়। কেউ যদি আমার পাণ্ডুলিপি দেখেন, দেখবেন, সেখানে অনবরত কাটাকাটি চলেছে।
রাশেদ: আপনি লিখেছেন, ‘যতদিন বেঁচে আছি কোন লেখা সম্পর্কেই আমি এ কথা বলতে পারব না এটাই শেষ পাঠ।’ নিজের কবিতা সম্পর্কে আপনারই একটা অনিশ্চয়তা থেকে গেল না?
আবুল হোসেন: কবিতা লিখে একটা অতৃপ্তি আমার মধ্যে সব সময় থেকে যায়। আমার মনে হয়, যা লিখেছি, এর চেয়ে ভালো লিখতে পারলে আরও খুশি হতাম।
রাশেদ: একটি কবিতায় আছে, আপনি একবার হারিয়ে গিয়েছিলেন। ওই একবারই?
আবুল হোসেন: সেবার একটা লোক আমাকে হাত ধরে বাড়িতে দিয়ে এসেছিল। বয়স যত বেড়েছে, পথের সন্ধান করে গেছি, চিরকাল। নিজের পথ নিজে খুঁজে পেয়েছি। কারও হাত ধরে অগ্রসর হতে হয়নি। তা না হলে কি এত কবিতা লিখত পারতাম?
রাশেদ: আপনার অনুবাদ কবিতা সংকলিত হয়েছে এই সংগ্রহে। কার কবিতা অনুবাদ করতে ভালো লেগেছে বেশি?
আবুল হোসেন: দু-তিনজনের কথা বিশেষ করে বলব। ডব্লিউ বি হয়েটস, মোহাম্মদ ইকবাল ও রুশ কবি রসুল গামজাতব। এঁদের কবিতা অনুবাদ করতে আমি বিশেষ আনন্দ বোধ করেছি।
রাশেদ: কোন কাব্যগ্রন্থের প্রতি আপনার বেশি পক্ষপাত?
আবুল হোসেন: নিজের সন্তানদের মধ্যে কাউকে বিশেষভাবে পছন্দ করা যায় না। তা সত্ত্বেও যদি কাউকে বেছে নিতেই হয়, তাহলে আমি বলব এখনও সময় আছে বইটির কথা। অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো কবিতা আছে এ বইয়ে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Leave a Reply