জাহানারা ইমামের সংগ্রাম
মশিউল আলম
যুদ্ধাপরাধীর বিচার: জাহানারা ইমামের চিঠি—আসিফ নজরুল \ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ \ অন্যপ্রকাশ, ঢাকা \ ৮৮ পৃষ্ঠা \ ১২০ টাকা
নব্বই দশকের শুরুতে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যখন এক অভিনব আন্দোলন শুরু হয়, সে-সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতেন আসিফ নজরুল, যিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক, যুবক বুদ্ধিজীবী ও একজন সুপরিচিত কলাম লেখক। সাংবাদিক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষের একজন প্রবল অ্যাকটিভিস্ট। সেই সুবাদে তিনি জাহানারা ইমামের যে ব্যক্তিগত সান্নিধ্যের বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন তার ফসল তাঁর লেখা বই ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার: জাহানারা ইমামের চিঠি’।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে জাহানারা ইমামের আহ্বানে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয় ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ নামে ১০১ সদস্যবিশিষ্ট এক নাগরিক কমিটি, যাঁদের মধ্যে আসিফ নজরুলও ছিলেন। তার তিন সপ্তাহের মাথায় আওয়ামী লীগসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল, ১৫টি ছাত্রসংগঠন, ১৩টি নারী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের চারটি সংগঠন ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমন্বয়ে বৃহত্তর পরিসরে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। জাহানারা ইমাম সর্বসম্মতিক্রমে এই বৃহত্তর মঞ্চেরও আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তাঁরা রাজধানীর সোহ্রাওয়ার্দি উদ্যানে আয়োজন করেছিলেন গণআদালতের, সে আদালত বিচার করেছিল যুদ্ধাপরাধীদের। সে-সময় ক্ষমতায় ছিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাঁদের সখ্য। যদিও বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবির পক্ষে তাঁদের সমর্থন ছিল, তবু জাহানারা ইমামসহ গণআদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২৪ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে সে-সময়ের বিএনপি সরকার রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে মামলা করেছিল, তাঁদের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালিয়েছিল। আসিফ নজরুল ছিলেন সেই ২৪ আসামির মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।
এই সুবাদে নব্বই দশকের সেই অভূতপূর্ব আন্দোলনের ভেতরের অনেক কিছু দেখার ও বোঝার সুযোগ পেয়েছিলেন আসিফ নজরুল। আন্দোলনটি কীভাবে সূচিত হয়েছিল, ধীরে ধীরে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং স্বাধীনতার পরের দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিস্মৃত একটি বিষয়কে জাতির স্মরণে এনে একটি প্রধান জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করেছিল, তার বিবরণ সংক্ষেপে দিয়েছেন আসিফ নজরুল। গণআদালতের ধারণাটিও তিনি সংক্ষেপে পরিষ্কার করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার দায়িত্ব সরকারের; জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আন্দোলন সরকারকে সেই দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিল। গণ-আদালতের রায়ের শেষাংশ তিনি প্রাসঙ্গিকভাবে উদ্ধৃত করেছেন: ‘যেহেতু গণআদালত কোনো দণ্ডাদেশ কার্যকর করে না, সেহেতু অভিযুক্ত গোলাম আযমকে আমরা দোষী সাব্যস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছি।’
শহীদজননী ও শহীদজায়া জাহানারা ইমাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আশায় বেঁচে ছিলেন ২৩ বছর, মন্তব্য করেছেন আসিফ নজরুল। বিচারের দাবিতে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন জীবনের একদম শেষ প্রান্তে পৌঁছে। তাঁর নেতৃত্বে ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন কেন শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে, কেন তার আগে নয়? এমন প্রশ্ন মনে জাগে। নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের অবসান ও একানব্বইয়ে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনের ফলে যে রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার সঙ্গে ওই আন্দোলনের কোনো যোগসূত্র ছিল কি না সে বিষয়ে আসিফ নজরুল কিছু আলোকপাত করেননি। তবে আন্দোলনটি কেন মাত্র বছর দুয়েকের মধ্যেই তখনকার মতো স্তিমিত হয়ে পড়েছিল তা সম্পর্কে লেখকের একটি ব্যাখ্যা আছে এ বইতে। সেটি এরকম: ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’তে ক্রমে সংখ্যাধিক্য ঘটে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের। ১৯৯৪ সালের প্রথমার্ধ নাগাদ বিএনপি সরকার-বিরোধী আন্দোলন বেগবান হয়ে ওঠে। ‘একাত্তরের হত্যাকারীদের বিচারের সঙ্গে ১৯৭৫-এর বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি সংযুক্ত করার জন্য কেউ কেউ জাহানারা ইমামের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। নির্মূল কমিটি ও সমন্বয় কমিটির নেতারা এ প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন।’ এসবের সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন জাহানারা ইমামের মৃত্যু। আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল তাঁর হাতে, অবসানও ঘটল যেন তাঁর জীবনাবসানের মধ্য দিয়ে।
আসিফ নজরুল আরও লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি শিকেয় ওঠে। সমন্বয় কমিটির নেতারা যেন পণ করে বসেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলন বেগবান রেখে কোনোভাবে যাতে আওয়ামী লীগ সরকারকে বিব্রত করা না হয়। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেই আওয়ামী লীগ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরে সেই বিচারের কোনো রকম অর্থবহ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি দলটি। সমন্বয় ও নির্মূল কমিটিও আওয়ামী লীগ শাসনামলে এই বিচারের আন্দোলনটি প্রায় গুটিয়ে ফেলে।’
আসিফ নজরুল বইটি লিখেছিন ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় ও সরকারের দায়িত্বগ্রহণের পর, এবং বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ সময়ে সেক্টর কমান্ডার ফোরামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়েছে এবং এবার খোদ আওয়ামী লীগ সরকারও এ আন্দোলনে শরিক আছে। আসিফ নজরুল লিখেছেন: ‘একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাস্তবায়ন করার জন্য আসলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার দৃঢ়তা। এই দৃঢ়তা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল আওয়ামী লীগেরই থাকা উচিত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে স্মরণকালের বিশালতম সমর্থন পাওয়ার পর এই দৃঢ়তা না দেখানোর কোনো যুক্তি নেই।’
বইটির বাড়তি পাওনা জাহানারা ইমামের সঙ্গে আসিফ নজরুলের মা-ছেলের মতো নিবিড় ব্যক্তিগত সম্পর্কের কিছু বিবরণ, কিছু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ। এসবের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মুহূর্তে ফুটে উঠেছে জাহানারা ইমামের ব্যক্তিগত চারিত্রিক দৃঢ়তা, সাংগঠনিক বিচক্ষণতা ও এক স্নেহময়ী মায়ের রূপ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Hasan
যুদ্ধাপরাধীর বিচার: জাহানারা ইমামের চিঠি—আসিফ নজরুল
(জাহানারা ইমামের সংগ্রাম)
The e-Book Edition is Available in
http://DeshiBoi.com
SK
Asif Nazrul actually a agent of ISI and had very close colaboration with Jamayaties and DGFI during 1/11. So, Asif speakes bullshit. Read Shahriar Kabirs book on last days of Jahanara Imam.
SK