ইতিহাসের চূড়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে
তাওসিফ জামিল
তেরো মাসের সূর্য কিরণ \ আজিজুল জলিল \ ফেব্রুয়ারি ২০১০ \ পরমা, ঢাকা \ প্রচ্ছদ: দীপক রায় \ ১৬০ পৃষ্ঠা \ ২০০ টাকা।
আজিজুল জলিলের তেরো মাসের সূর্য কিরণ বইটি পড়তে গিয়ে কখনো ইতিহাসের স্বাদ, কখনো গল্পকাহিনির আবহ, কখনো বা রোমাঞ্চ জাগে। তিনটি পর্বে ৩৫টি লেখা নিয়ে এই বই। প্রথম রচনা ‘চল্লিশের দশক—উত্তাল সময়’ লেখাটি পড়তে গিয়ে বর্তমান নিবন্ধকারে হাত চলে গিয়েছিল আর কে নারায়ণের ‘অ্যা মালগুড়ি অমনিবাস’-এর দিকে। কারণ আজিজুল জলিল তাঁর ছাত্রজীবনের কথা বলতে গিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শেষটুকুর বর্ণনা দিয়েছেন। হঠাৎ মনে হয় আর কে নারায়ণের এই অমনিবাসের প্রথম উপন্যাস স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস-এর একটা আবহের স্বাদ যেন এতে ছিল। জলিলের জন্ম খুব সম্ভবত ১৯৩৩ সালে। ১৯৪৬ সালে তিনি যখন স্কাউটের সদস্য হিসেবে জ্যোতি বসুর নির্বাচনী প্রচারণা তাঁবু পাহারা দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর বয়স ১৩ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
শুরুতেই গোলাগুলি আর ধ্বংসযজ্ঞের ভেতর দিয়ে দেশত্যাগের বর্ণনা। তারপর ইতিহাসের তবলা-বাঁয়াতে নিজের অভিজ্ঞতার তাল ঠুকে ঠুকে এগিয়েছে এই বই। বইটি মূলত ইংরেজিতে লেখা তাঁর অনেকগুলো প্রবন্ধ-নিবন্ধের অনুবাদ। অত্যন্ত প্রাঞ্জল গদ্যে স্থপতি দম্পতি খোন্দকার শহীদুর রব ও ওয়াজেদা জাফর কাজটি করে দিয়েছেন।
পেশাগত জীবনের শুরু থেকেই আজিজুল জলিল সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘কর্মস্থল টাংগাইল’, ‘চাঁদপুর’ ও ‘ফেইরি হিরে নিবাস—চিটাগাং-এর কাহিনী’সহ প্রত্যেকটি লেখা কেবল সুখপাঠ্যই নয়, মনন ও বোধনজাগানিয়া। রাসেল থেকে সুভাষ বোস, হিটলার থেকে কেনেথ কাউন্ডা কি রণদাপ্রসাদ সাহা—কত ব্যক্তির কথা যে এসেছে, তার ইয়ত্তা নেই।
ছোটবেলা থেকে তাঁর সঙ্গে এমনসব মানুষের সাক্ষাৎ হয়েছে, যাঁদের অনেকেই আজ ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। নিজেকে যতটা পারেন আড়াল করে গেছেন। নিজের ভূমিকা, আত্মপক্ষ সমর্থন ও আত্মগৌরব বৃদ্ধির বদলে তাঁর লেখাগুলো হয়ে উঠেছে তাঁর সমকালের অনেক মানুষের খণ্ড খণ্ড জীবনী। ফলে এতে যা উঠে এসেছে, তাকে আমরা তাঁর ‘সমাত্মজীবনী’ বলতে পারি।
কলকাতায় শৈশব, ঢাকায় কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিনগুলো; পরে লন্ডনের স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়তে যাওয়া, তারপর সরকারি চাকরি—এসব ঘটেছে ১৯৩৩ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু ১৯৭১ সালে। ১৯৯০ পর্যন্ত সেখানে কর্মরত ছিলেন। এই সংস্থার হয়ে বেশ কয়েকটি দেশে তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা বলে কথা! ফলে তাঁর দেখা হয়েছে সেসব দেশের সরকারপ্রধান ও আরও অনেক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে। তেরো মাসের সূর্য কিরণ লেখায় এসেছে তাঁর জাম্বিয়া-বসবাসের অভিজ্ঞতা। সমুদ্র থেকে গড়ে চার হাজার ফুট ওপরে থাকা জাম্বিয়া সবসময় রৌদ্রোজ্জ্বল থাকে। এ জন্যই তিনি বলেছেন, এখানে বারো মাসের তেরো মাসই আলো-ঝলমল।
অনেক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের ভেতরে শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী ও তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে অল্প কথায় যেটুকু বলেছেন, সেটি যেকোনো পাঠকের মনে দাগ কাটবে। তাঁকে গভীরভাবে তাড়িত করেছে দেশভাগ, পাকিস্তানের বিভক্তি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। মূলত ইতিহাসের আতস কাচে নিজের পেরিয়ে আসা সময়ের ওপরই আলো ফেলেছেন তিনি। এবং সেই আলো সূর্যের আলোর মতোই স্বচ্ছ ও সত্যের নিরিখে পরীক্ষা করে নিতে চেয়েছেন। নৈর্ব্যক্তিকভাবে দেখেছেন নিজের ব্যক্তিগতজীবন ও পারিবারিক প্রসঙ্গগুলোও। প্রায়ই মনে হয় নিজের নয়, অন্য কারও কথাই যেন বলছেন। তাই কবি র্যাবোঁর সেই কথাই যেন প্রতিধ্বনিত হয়, ‘আমি হচ্ছি অন্য কেউ’, যে ইতিহাসের হাত ধরে কেবল হেঁটেছি সমানে। একটি স্বচ্ছ, সফল ও বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হয়ে নিজেকে আড়ালে রাখার দুর্লভ ক্ষমতা কারও জীবনব্যাপী অটুট থাকে, থাকতে পারে—এই বই তার সাক্ষ্য হয়ে রইল।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Leave a Reply