পাখি নিয়ে বাঙালির আতিশয্যের শেষ নেই। আমাদের কাব্যসাহিত্যে পাখির বড় জায়গা। ‘হায় চিল সোনালি ডানার চিল’ বলে জীবনানন্দ দাশ একদিন কবিতায় যে পাখিপ্রতিমা এঁকেছিলেন, ক্যামেরার ফ্রেমে, আলোছায়ার দোলাচলে সেই পাখির বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা হলো। এক-দুটি নয়, নানা ভঙ্গির অসংখ্য পাখি। যেন এক পাখির হাটে এসে পড়েছি। দৃক গ্যালারিতে গত ২৫ জুন শুরু হয়েছে এই পাখির মেলা। ডা. নিয়াজ রহমানের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘পাখায় পাখায় ছন্দ’ মানুষের ভিড়ভাট্টার এই শহরে নিয়ে এসেছে একঝাঁক পাখি।
মোট ৭৬টি আলোকচিত্র। প্রদর্শনীটি চলবে ২ জুলাই অব্দি। কী পাখি নেই আলোকচিত্রীর ফ্রেমে—দোয়েল, হলদে পাখি, বনমোরগ থেকে শুরু করে আছে রাজহাঁস, মেটে রাজহাঁস, কাঠ শালিক, ভাত শালিক প্রভৃতি। প্রদর্শনীটির নাম পাখায় পাখায় ছন্দ, আমাদের চোখও ছন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছে। প্রথম আলোকচিত্রে দেখা যায়, গাছের ডালে একাকী দোয়েলের অবয়ব। দোয়েলটি বসে আছে চুপচাপ। দ্বিতীয় আলোকচিত্র ধারণ করে আছে দুটি কালো বুলবুল পাখির শরীর; যার মধ্যে একটি সরু ডালের শীর্ষে বসা, অন্যটি উড়াল-উদ্যোগী। এই ছবির ক্যানভাসটি সাদা। সাদা পটের মধ্যে বুলবুলের কম্পোজিশন। এখানে সাদা-কালো বিন্যাসের মাধ্যমে এক ধরনের ছন্দ জারি হচ্ছে।
নিয়াজ রহমানের চিত্রমালায় অনেক ক্যানভাসে দেখা যায় পাখি সব উড়ছে; কখনো রাজহাঁস উড়ে যাচ্ছে, কখনো উড়ন্ত শঙ্খচিল ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। ‘পাখপাখালির এই ওড়াউড়ির মধ্যেই কিন্তু ছন্দ আছে।’ বললেন নিয়াজ রহমান। পেশায় তিনি চক্ষু চিকিৎসক। প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বললেন, ‘পাখি আর মানুষ বহু দূরে বাস করে না, তবে তাদের দেখতে হলে চাই আমাদের মন ও ভালোবাসার দুটি চোখ। আমাদের দুটি চোখ যদি পাখির জগতের কাছাকাছি আনতে পারি তবেই আমরা চিনব, জানব ও দেখতে পাব পাখির ভুবনের অপার রহস্য।’ ক্যামেরাবন্দী পাখির রূপমাধুরী নিয়াজ রহমান ছড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর এই প্রদর্শনীতে। ছবিতে বিষয় যেহেতু পাখি, তাই পাখিকে ফোকাস করার প্রয়োজনে নিয়াজ অন্যান্য অবজেক্টকে ঝাপসা করে দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন ওয়াইড অ্যাপারচার। ভাত শালিকের ক্যানভাসের কথাই ধরা যাক: ছবিতে গাছের পলকা ডালে দেখা যাবে একটি ভাত শালিকের মুখ বাঁকানো শরীর। শালিকটি বসে আছে। এখানে শালিকের অবয়ব স্পষ্ট, এমনকি পা ও মুখের হলুদ রংও স্পষ্ট। গাছের ডালটিও দেখা যায় ঠিকঠাক। কিন্তু ক্যানভাসের বড় একটা অংশ অর্থাৎ পাতা-পত্রাবলি ঝাপসা ও হালকা। ফলে শালিকের উপবেশনভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে সবুজাভ ও সাদার বিন্যাসে আলোকচিত্রটি আপনা-আপনি অপূর্ব হয়ে উঠেছে। ছবির বিষয় অক্ষুণ্ন রেখে যথাযথ রঙের ব্যবহার এবং বহুবর্ণ রঙের সমতা বিধান করতে জানেন এই আলোকচিত্রী। তাই তো আলোকচিত্রে নিয়াজের পক্ষিকুল যখন উড়ে যায় বা নিশ্চুপ একাকী বসে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তখন সে স্থবির থাকে না; বরং পাখিরাও নিঃশব্দে কথা বলে। প্রকাশ করে প্রকৃতির মধ্যে উপ্ত থাকা তাদের ছন্দ। যেন বা পাখি সব করে রব…আলোকচিত্রী নিয়াজ রহমানের ক্যানভাস তো এমনই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Leave a Reply