স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ করেছেন রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
মারিও বার্গাস য়োসা রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবে পেরুভিয়ান লেখক মারিও বার্গাস য়োসা একটা সম্মানজনক পদে আসীন। ফুটবল নিয়ে তাঁর আগ্রহ আছে। ফুটবল নিয়ে য়োসার সঙ্গে এই কথোপকথনটি প্রকাশিত হয়েছিল স্পেনের দৈনিক এবিসি পত্রিকায়, ২০০৯-এ।
সহস্র ও এক আরব্য রজনীর চাঁদনিচকে দাঁড়িয়ে সুলতান শাহরিয়ার মারিও বার্গাস য়োসা ভক্তি ও ভালোবাসা নিয়ে তাকান সেই সান্ধ্যকালীন রাস্তার দিকে, বহু আগে, যেখানটায় তাঁর চাচা তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন লিমার জাতীয় স্টেডিয়াম দেখাতে। সেটা ছিল ১৯৪৬ সাল। সে মাঠে খেলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাব। সেদিন থেকে বিখ্যাত এই লেখক হয়ে গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সমর্থক। এমনকি সেই দলের খেলোয়াড় পেরুর লিজেন্ড আলবের্তো তোতো, অর্থাৎ আলবের্তো তেরিরর পরনের একটি বেইজ-রঙা কোট ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহ করেছিলেন। ঘটনাচক্রে তেরির আর বার্গাস য়োসা একই মহল্লায় থাকতেন। য়োসা বলেন, ‘তেরিরকে সবাই ডাকত সেন্ট রুবিও বা স্বর্ণকেশী, যেমনটা ডাকা হতো দি স্তেফানোকে, সোনালি চুলের জন্য যিনি আমার বাল্যকালের আরেক মিথ।’ তেরির খেলত লেফটব্যাক হিসেবে। অসাধারণ সেই খেলা। একদিন তেরির বার্গাস য়োসাকে নিয়ে গেল মাঠের ঘাস দেখাতে। য়োসা মনে করতে পারেন, ‘সঙ্গে আরও ছেলেপুলে ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের জার্সি-প্যান্ট পরে আলিয়ানসা লিমার পোলাপাইনের বিরুদ্ধে খেললাম, পেরুর ঘরোয়া লিগের সবচেয়ে বড় ম্যাচ ওটা। আজ আর ঠিক মনে নেই ফুটবলে আদৌ লাথি দিয়েছিলাম কি না, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের জার্সি গায়ে দিয়ে জাতীয় স্টেডিয়ামের ভেতর আমি…এর চেয়ে আর বেশি চাওয়ার কী থাকতে পারে!’ মারিও বার্গাস য়োসার ফুটবল খেলা আর হয়নি, হয়ে গেলেন সাঁতারু। তিনি বলেন, ‘একটা মাত্র খেলায়, মানে সাঁতারে ভালো করলাম।’
এবিসি: দূরপাল্লার সাঁতার নাকি ছোটপাল্লার?
বার্গাস য়োসা: ছাত্রাবস্থায় কোচাবাম্বায় স্থানীয় টুর্নামেন্টে অংশ নিয়েছিলাম। ফ্রি-স্টাইলের সাঁতার ছিল আমার প্রিয়।
এবিসি: আর ফুটবলে কোন পজিশনে খেলতেন?
বার্গাস য়োসা: মিডফিল্ডে। ফুটবলের নিরবচ্ছিন্ন জ্যামিতির শিল্পী সক্রেটিস, প্লাতিনি, তিগানা, জিরেস, জিকো, ফাব্রেগাস, শাবি প্রমুখের মতো। এঁরা হলেন কুশলী পরিচালক। মিডফিল্ডই খেলার কৌশলের ভিত্তি।
এবিসি: আপনার বিয়ে হয়েছিল ব্রাজিলের মারাকানা মন্দিরে। বিয়েটা কেমন ছিল?
বার্গাস য়োসা: জীবনে প্রথম মারাকানা স্টেডিয়াম দেখার আবেগটা মনে করে আজও শিহরিত হই। ওখানেই কেটেছিল আমাদের মধুচন্দ্রিমা।
এবিসি: স্টেডিয়াম কেন?
বার্গাস য়োসা: আমার স্ত্রী জীবনে কখনো স্টেডিয়াম দেখেনি, ফুটবলের কিছুই বুঝত না সে। ওকে নিয়ে রিও দে জানেইরো গেলাম এবং সৌভাগ্যক্রমে ব্রাজিলের জাতীয় দলের সঙ্গে জার্মানির জাতীয় দলের খেলার টিকিট জোগাড় করতে পারলাম। পেলে খেলেছিলেন। অবিস্মরণীয়! আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ খেলোয়াড়। পেলে একই সঙ্গে মিথ ও বাস্তবতা।
এবিসি: গারিরঞ্চা কি মিথ, না বাস্তবতা?
বার্গাস য়োসা: রাজকীয় খেলা ফুটবলের এক মিথ গারিরঞ্চা। ব্রাজিলীয় ফুটবল আমাকে খুবই টানত। কারণ, একেকজন অনন্যসাধারণ খেলোয়াড়ের সমাহার হলো ব্রাজিল। ব্রাজিলের ফুটবল শুধুই জেতা ও গোল দেওয়ার প্রতিযোগিতা নয়, একই সঙ্গে এ এক নৈপুণ্যের প্রদর্শনী, যেখানে সৃষ্টিশীলতা, কল্পনা এবং প্রত্যেক খেলোয়াড়ের সৃজনীশক্তি মেলে ধরা হয়। ব্রাজিলের ফুটবল যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল তা আর কারও ছিল না। আমার মনে হয়, আজ সে অবস্থা আর নেই, হারিয়ে গেছে। এখন ফলাফলটাই মুখ্য। এখন বিভিন্ন দেশের ফুটবল প্রায় সমান সমান হয়ে গেছে। আজ আর ওই দৃশ্য চোখে পড়ে না, যদিও মাঝেমধ্যে ব্যক্তিনৈপুণ্যে ভরপুর খেলোয়াড়ের আবির্ভাব ঘটছে। কিন্তু ১৯৫৮, ১৯৬২ সালের ক্ল্যাসিক ব্রাজিল দল আর ‘বের্দেয়ামারেলহো’ বা হলুদ-সবুজের অবিস্মরণীয় সেই ১৯৭০-এর দল আর একটিও জন্মাবে না। অসাধারণ সেই দল। ফলপ্রসূতা, কৌশলের সঙ্গে প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব নৈপুণ্য প্রদর্শনের স্বাধীনতার সংযোগ এবং চাতুরির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল সেই দল। কার্লোস আলবের্তো, এবেরালেদা, ক্লোদোয়ালেদা, গার্সন, জর্জিনহো, তোস্তাও, রিবেলিনো, পেলে…আহ্, চোখে লেগে আছে…
এবিসি: মারাদোনা কি পতিত তারকা?
বার্গাস য়োসা: মারাদোনা দুজন। একজন ফুটবল মাঠের, পেলের পর যিনি আমার ধারণায় ফুটবলের মহত্তম মিথ। তাঁর সঙ্গে আছে সেই ট্র্যাজিক মারাদোনা, যে জনপ্রিয়তার ভার নিতে পারেনি। দুর্ভাগ্যবশত সে নিজের জীবনটাকে একটা তাচ্ছিল্যের মধ্যে নিয়ে গেছে। এ এক চরম বৈপরীত্য। আলবেয়ার কামুর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ছে আমার—‘একটা নির্দিষ্ট কাজে অসাধারণ পটু কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো কাজে একেবারেই গুরুত্বহীন ও অপদার্থ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।’ মারাদোনার এই বৈপরীত্য তাঁকে এক ট্র্যাজিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১০
Leave a Reply