আমার দেখা সবচেয়ে বিস্ময়কর ফুটবল হলো সৈনিকের এক পুরোনো তোবড়ানো জুতো, ভেতরটা ঠাসা কাগজ, মাটি আর ছেঁড়া কাপড়ের টুকরোয়। এই আজব ফুটবলের খেলোয়াড়েরা বলটাকে পুরোদস্তুর গোল না বানাতে পারলেও বাঁধাছাঁদার পর খানিকটা ডিম্বাকৃতি দিতে সক্ষম হয়েছে। এটা ১৯৮০ সালের মাঝামাঝির কথা। ফুটবল ম্যাচটি হচ্ছিল বুয়েনেতে, মোজাম্বিকের রাজধানী মাপুতুর বাইরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। মাঠ বলতে এটা এক রোয়া-ওঠা এবড়োখেবড়ো খেত। আর খেত সন্নিহিত খালি জায়গা এক মৃত্যুফাঁদ। কারও সাহস নেই ওখানে পা দেয়। কারণ? পুরো খেতে পোঁতা মাইন।
দুঃসহ গৃহযুদ্ধে মোজাম্বিক ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। এক পক্ষে বৈধ ফ্রেলিমু (মোজাম্বিকান লিবারেশন ফ্রন্ট) সরকার, অন্যপক্ষে মোজাম্বিক ন্যাশনাল রেজিস্ট্যান্টস বা রেনামু, প্রায় ভূতসদৃশ এই বিদ্রোহী বাহিনীর স্রষ্টা দক্ষিণ রোডেশিয়ান সিকিউরিটি ফোর্স। এই সময়ের কথা স্মরণ করে আমি আজও আঁতকে উঠি। ভাবি, সন্ধ্যার আধো আলো-আঁধারিতে কী করে আমি মাপুতুতে মহড়া সেরে একা গাড়ি চালিয়ে ফিরতাম। আসার পথে কতবার দূরের কাতেম্বা উপদ্বীপের ঘরবাড়ি আগুনে জ্বলতে দেখেছি। রেনামুর অস্ত্রধারীদের নির্বিচারে গুলি চালাতে দেখেছি নিরীহ মানুষের ওপর, আক্রমণ থেকে পালাতে পারেনি এমন কতজনকে বিনা অপরাধে বুলেটবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখেছি রাস্তার ধারে—এত কিছুর পরও এখনো আমি বছরের অর্ধেকটা সময় এখানেই কাটাই।
আর এসবের মধ্যেই ফুটবল খেলা হয়। এই খেলা যেন শত দুঃখ-কষ্ট ভোলার একমাত্র দাওয়াই। ওই গরিবগুর্বো ছেলেগুলোর পায়ে জুতো থাকে না, পরনে ময়লা শতছিন্ন কাপড়। তার পরও ওরা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে, সব শক্তি দিয়ে খেলাটা খেলে যায়। আর ওই এবড়োখেবড়ো করুণ দশার মাঠে ফুটবল খেলার কারণেই কিনা জানি না, গোড়া থেকেই এরা গড়ে ওঠে একেকজন দক্ষ খেলোয়াড় হিসেবে, কিন্তু দলগতভাবে এরা খেলতে শেখে না, বল নিয়ে এক জায়গায় তালগোল পাকিয়ে ফেলে। খেলা নিয়ে ছেলেগুলো সিরিয়াস না মোটেও। ওরা খেলে শুধু মজা লোটার জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও যেন ওদের চারপাশ থেকে ঘিরে থাকা রক্তাক্ত, নারকীয় পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদও। ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেখছি, কী আশ্চর্য দক্ষতায় ছেলেগুলো ওই পুরোনো জুতোর খেলা চালিয়ে যাচ্ছে, আজও। আর বিষয়টি নিয়ে এটাও ভাবি, ওদের একেবারে ঘরের কাছেই, বুয়েনো থেকে মাপুতু, তারপর গাড়িতে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল, যা আফ্রিকা মহাদেশে এই প্রথম। আমি যদি ওই ছেলেগুলোকে এই খবর শোনাই, হয় ওরা ভাববে আমি কোনো দেবতা অথবা কোনো গ্রাম্য নির্বোধ।
খুব বেশি পেছনের ঘটনা নয়। এক সময় দক্ষিণ আফ্রিকা ছিল অচ্ছুৎ, একঘরে। কেউ তাদের সঙ্গে কোনো কিছু করতে আগ্রহী ছিল না; ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সব সময়। সেটা অন্যায়ও ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে একমাত্র খেলাধুলার ক্ষেত্রেই সামান্য যা কিছু আদান-প্রদান বজায় ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা মানে তখন চরম এক লজ্জা।
এখন ইতিহাস বদলে গেছে, বদলেছে অনেকের প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত। ঠিকই একদিন নেলসন ম্যান্ডেলা রুবেন আইল্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন, শুধু একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে নয়, একজন বিজয়ী বীরের মতো। বর্ণবৈষম্যকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চিরতরে।
শুধু ম্যান্ডেলার কারণে কিংবা শুধু ম্যান্ডেলাকে দেখে ফিফা দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বকাপের আয়োজক করেনি। কিন্তু ম্যান্ডেলা এখনো চ্যালেঞ্জ বিজয়ের এক ধরনের প্রতীকী নিশ্চয়তা; ম্যান্ডেলার দেশ, ম্যান্ডেলার জাতি চ্যালেঞ্জ পূরণে পিছপা হবেন না কখনো—ফিফার এই বিশ্বাস ছিল। ফিফার সে বিশ্বাস তাঁরা রেখেছেন। শুরুতে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিয়ে সমস্যা ছিল। নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় ছিল, নির্মাণ ও অবকাঠামো নিয়ে কিছু কেলেঙ্কারি হয়েছে, যার বেশির ভাগই দুর্নীতিসংশ্লিষ্ট। নানা রটনা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার সামর্থ্য নিয়েও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা সব আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করেছে, জাবুলানি গড়াচ্ছে এখন মাঠে।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও অন্যান্য আফ্রিকান দেশের কাছে বিশ্বকাপ হলো জাতীয় অহংকার। আগের বিশ্বকাপগুলোয় দূরের দেশের খেলা রেডিওতে শুনে না হয় টেলিভিশনে দেখেই তৃপ্ত থাকতে হয়েছে আফ্রিকাবাসীকে, কিন্তু আফ্রিকান ঐক্য তখনো ধ্বনিত হয়েছে মহাদেশটির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত। ১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের সাফল্যে গোটা আফ্রিকা মাতোয়ারা ছিল। ১৯৯৪ সালে ব্রাজিলের বিশ্বজয়ে মাপুতুবাসীর আনন্দ আমি নিজের চোখে দেখেছি। গাড়িতে হর্ন বাজাতে বাজাতে উল্লাস, যেন ব্রাজিল নয়, বিশ্বকাপ জিতেছে মোজাম্বিক। আসলে আনন্দের জন্য আফ্রিকাবাসীর বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। ব্রাজিল-মোজাম্বিক দেশ দুটোর ভাষা এক—পর্তুগিজ। এ উপলক্ষই যথেষ্ট। ব্রাজিলের বিজয় মানেই এদের কাছে মোজাম্বিকেরও জয়।
২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে অ্যাঙ্গোলার সুযোগ পাওয়াও আফ্রিকাবাসীকে উদ্বেলিত করেছে। অ্যাঙ্গোলাকে খেলতে হয়েছে একই গ্রুপে পর্তুগালের সঙ্গে, যে দেশটি তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক। ওই খেলা দেখার জন্য আমি কলনে ছুটে গিয়েছিলাম, পর্তুগাল কোনো রকমে ১-০ গোলে জয় পেয়েছিল সেদিন। কিন্তু আফ্রিকার মানুষের কাছে জয়ের চেয়ে বড় গর্বের ছিল এটাই যে, সাবেক শাসকের সঙ্গে তারাও সুযোগ পেয়েছে বিশ্বকাপে খেলার।
অনেকেই বিস্মিত হয়, আফ্রিকান ফুটবলকে কি আলাদাভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব! যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকার নাম। উত্তর হলো একই সঙ্গে না এবং হ্যাঁও।
আফ্রিকা মহাদেশ এত বিশাল, যেমন স্বতন্ত্রভাবে এক নাইজেরিয়ার কথাই বলা যায়। ভৌগোলিক আয়তনে কিংবা জনসংখ্যার দিক থেকেও প্রায় গোটা ইউরোপের বড় একটা অংশের সমান। কিন্তু আমরা এখানেই যে ভুলটা করি, আফ্রিকাকে আমরা সব সময় দেখি একটি দেশের মতো করে। কিন্তু বাস্তবে ইউরোপের ফুটবলের মতো আফ্রিকান ফুটবলেও বৈচিত্র্য রয়েছে। ইউরোপের সব ফুটবল খেলুড়ে দেশ একরকম ফুটবল খেলে না। তেমনি আফ্রিকানরাও ভিন্ন ভিন্ন ফুটবল খেলে। কেউ বিশ্বাস করে না কোনো আফ্রিকান দেশ এবার ফাইনালে যেতে পারবে। কিন্তু এ বছর না ঘটুক, এটা ঘটবে খুব শিগগিরই, আফ্রিকায় নয়, অন্য কোথাও।
আমি প্রায় মাপুতুয় ফুটবল খেলা দেখতে যাই। যে জিনিসটা আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে তা হলো দর্শক ও খেলার আবহ। কখনোই আমি ইউরোপীয় দর্শকদের মতো আগ্রাসি সমর্থক দেখিনি এখানে। আজ পর্যন্ত সমর্থকদের কোনো দাঙ্গায় জড়িয়ে পড়তে দেখিনি আমি। স্টেডিয়ামজুড়ে থাকে অবিশ্বাস্য মেলা বা উৎসবের এক আনন্দ, হুল্লোড়। ঢোলের আওয়াজ, বাঁশির ফুৎকার, উত্তাল নাচ, নানান লম্ফঝম্ফ, চিৎকার-চেঁচামেচি; কিন্তু খেলার বিদ্যুৎসম উত্তেজনা, দৃঢ়তা কখনোই সমর্থকদের বেশামাল করে দেয় না। আমি মনে করি, আফ্রিকার এই সমর্থক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক ফুটবলের জন্য এক বিরাট উপহার।
আর এটাও মনে করি, আফ্রিকার সহায়তায়ই ফুটবল ফিরে পাবে প্রকৃত ক্রীড়ারূপ, যা আজ অনেকখানি টাকার ঝনঝনানি, আকাশচুম্বী প্রত্যাশা আর গুরুতর বাণিজ্যিকীকরণে কালিমালিপ্ত। এখন ফুটবল আর পবিত্র নেই, অনেক বিশদ, অলিগলিতে ভরা।
এই বিশ্বকাপে মিডিয়ার কাছে আমার প্রত্যাশা, তারা শুধু আফ্রিকার মৃত্যু-জরা-ব্যাধি আর যুদ্ধের কথাই বলবে না, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সংগ্রামী মানুষগুলো যে বেঁচে আছে, প্রতিনিয়ত লড়ছে, সামনে এগোচ্ছে—সেসব গল্পও তারা তুলে আনবে।
এই ২০১০ বিশ্বকাপ আফ্রিকাকে নতুনরূপে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তুলবে—খারাপের পাশাপাশি ভালোটাও জানবে, জানাবে—আফ্রিকানদের কাছে ফুটবল এখনো পবিত্র। ফুটবল তারা খেলে এখনো এক অহংকার নিয়ে, প্রার্থনার সমতুল্য ভেবে।
অনুবাদ: আলীম আজিজ
হেনিং মানকেল
হেনিং মানকেলের জন্ম ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে, সুইডেনের স্টকহোমে। ২০ বছর বয়সে লেখালেখির শুরু। জড়িত ছিলেন বামপন্থী রাজনীতি ও থিয়েটারের সঙ্গে। তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ডিডেকটিভ সিরিজের নায়ক কুরট ভালেনডার। ছোটদের জন্যও লিখেছেন। বর্তমানে মানকেল বিশ্বের জনপ্রিয় লেখকদের একজন। ৪০টির বেশি ভাষায় তাঁর বই অনূদিত হয়েছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১০
Leave a Reply