হোর্হে লুইস বোর্হেস মারা গেলেন দিন কয়েক আগে, ১৪ জুন, সব ঘটনার প্রায় শুরুর দিকটায়। এই লেখক ফুটবল পছন্দ করতেন না মোটেই। তিনি বলতেন, ‘নন্দনতাত্ত্বিকভাবে বাজে একটা খেলা হলো ফুটবল। ১১ জন মিলে অন্য ১১ জনের বিপক্ষে একটা বলের পেছনে ছুটছে, ব্যাপারটা দেখতে মোটেই সুন্দর লাগে না…বরং ফুটবলের চেয়েও সুন্দর হলো মোরগের লড়াই। চাক্ষুষ সব ঘটনা, আর চোখে যারা কম দেখে তাদের জন্য তো আদর্শ খেলা।’
মনে কি পড়ে আমার? বোর্হেসের এসব মন্তব্য শুনে আমি মজা পেয়েছিলাম। ফুটবল নিয়ে আমার বাড়তি আকর্ষণ কোনো দিনই ছিল না, যদিও ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মারাদোনার অসাধারণ দ্বিতীয় গোলের সৌন্দর্যের প্রশংসা না করে থাকি কি করে! সত্তুরের দশকে নিরক্ষীয় অঞ্চলে নির্বাসনে থাকার দরুন আমার ভেতর বেসবলের যে পোকা সংক্রমিত হয়, সেটা রয়েই গেল। ওটাকে আমার সব সময় ফুটবলের চেয়ে বেশিই সাহিত্যিক মনে হয়েছিল।
ছোটবেলায় রাস্তায় রাস্তায় ফুটবল খেলার বাতিকটা আমার ছিল না, সেদিক থেকে অন্যদের চেয়ে আমার বিস্তর পার্থক্য। রক কনসার্টের জন্য যাওয়া ছাড়া ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আমার কোনো দিন কোনো স্টেডিয়ামে যাওয়া হয়নি। আমার স্টেডিয়ামে অভিষেক ঘটে অন্যদের তুলনায় অনেক পরে, অনেক বছর পর, সান লোরেন্সো ও বেলেসের মধ্যকার বিখ্যাত ফুটবল ম্যাচে, বলের ঘাটতি পড়ায় যে খেলা বন্ধ ছিল অনেকক্ষণ। ৪৫ মিনিটের জন্য সান লোরেন্সোর সমর্থক হলাম, অনেক হইহল্লা হলো। কিন্তু সেই যে স্টেডিয়াম ছাড়লাম আর যাওয়াই হলো না।
আমার পরিবারেও ফুটবল নিয়ে কোনো বিশেষ মাতামাতি ছিল না। আমার বাবা, আমি যতদূর জানি, এবিতা চ্যাম্পিয়নশিপে বাস্কেটবল খেলেছিলেন এবং পরিবারের খেলাধুলার রেকর্ড বলতে এই-ই যা।
আর এভাবে কোনো বিশেষ দলের প্রতি সমর্থন ব্যাপারটা আমার মধ্যে কোনো দিনই তৈরি হয়নি। পানভোজন-সংক্রান্ত একটি ম্যাগাজিনে কাজ করেছিলাম। অনেকটা সময় ওখানেই চলে যেত। গল্প লেখার কাজ বাদ দিয়ে ম্যাগাজিনের কাজই আমার সব সময় নিয়ে নিত। ১৯৮৬ সাল, আমাদের দল খেলতে গেছে মেহিকোর বিশ্বকাপে। খেলোয়াড়দের এটা-সেটা নিয়ে লেখাটা ধর্তব্যের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। দূর থেকে বসে লিখলাম ওদের নিয়ে এবং লেখার মধ্য দিয়ে একে একে সবাইকে চিনলাম। অচিরেই এই ভরসা মনে এল যে মেহিকোতে এবারের বিশ্বকাপটা আমাদেরই। আমার মনে হচ্ছিল, মেহিকোতে আমাদের উৎসব হবে।
এটা স্পষ্ট যে, বিস্ময়কর অবাক করা ঘটনার পেছনে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা থাকে যেমনটা শোয়ার্জেনেগারের সব সাফল্যগাথার পেছনে আছে এক বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে সুপরিকল্পিত ও নির্মিত স্পেশাল এফেক্টের কারসাজি। কিন্তু মেহিকো উৎসবে পরিণত হয়নি আমার জন্য। আমার মায়ের বাসা ছিল বুয়েনোস আইরেসের মেহিকো স্ট্রিটে এবং যেদিনটায় আমি মায়ের বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম, ঠিক সেদিনই হোর্হে লুইস বোর্হেস নামের একজন লেখক মারা গেলেন। তখন আমার যে প্রেমিকা এবং তার সঙ্গে আমার দিনগুলো যেরকম কাটছিল সেটার সঙ্গে ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্নদের দেখা মোরগ লড়াইয়ের মিল খুঁজে পাওয়া যায়—আঘাত, চোট, পালক ও দেখার অসাধ্যতা। এ কারণেই বিশ্বকাপের সময়টা কাটছিল মায়ের বাসায়। একটা ছোট সাদা-কালো টেলিভিশনে খেলা দেখতাম একটার পর একটা; নিচু স্বরে নিজেকে গালি দিতে দিতে। কত বছর হয়ে গেল এর বাইরে আমি। এখন সেটা আর ভাবাই যায় না।
যেদিন আমরা কাপ জিতলাম, আমার মনে আছে, সে রাতে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমার প্রেমিকার সঙ্গে ও তার বিরুদ্ধে যে খেলাটা খেলছি সেটা ক্লান্তিকর অতিরিক্ত সময়ে গড়িয়েছে, খেলাটায় আমরা এরই মধ্যে হেরে গেছি। একসঙ্গে খেতে গেলাম আমরা, পুনর্মিলনের সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে তত্ত্বকথা হলো আমাদের, যেটার কোনো প্রয়োজন বা তাগিদ আমরা কেউই অনুভব করছিলাম না এবং আগে থেকেই দুজনে আঁচ করেছিলাম যে, শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটবে না। মেহিকো স্ট্রিটে ফিরে যাওয়ার সময় ওবেলিস্কের কাছাকাছি রাস্তায় ২০০১: স্পেস ওডেসি সিনেমার প্রথম ভাগটা কিংবা সেসিল ডি. মিলের কোনো পোস্টকার্ডের কথা ভাবতে ভাবতে আমি মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করলাম যে, আজ মধ্যরাতে মেহিকো ৮৬ বিশ্বকাপের সেরা সব ঘটনা ও মুহূর্ত নিয়ে তৈরি করা বিশেষ টিভি অনুষ্ঠানে নিজেকে হারিয়ে ফেলব। আমার মনে তখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে করা মারাদোনার অবিশ্বাস্য সুন্দর দ্বিতীয় গোলটা। এই অলৌকিক ঘটনার পিছনে ছিল না কোনো কারিগরি কৌশল। পৃথিবীর কোনো ঘটনা নয় এটা, এর বাইরের কিছু একটা—অপার্থিব। একটা চমক। বাইরে, সান তেলমোতে, শীতের রাতে কেউ একজন দক্ষিণী মারিয়াচির নির্ভুল স্টাইলে রিভলবার খালি করল।
ফাইনালের কয়েক সপ্তাহ পর আমার জীবনের নায়িকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এবং আমি ভালো হয়ে উঠলাম। বিনিময়ে, ফুটবলকে নিয়ে আমার আগ্রহ আবার উবে গেল, সারা জীবনের জন্য।
স্প্যানিশ থেকে অনুবাদ: রফিক-উন-মুনীর চৌধুরী
রোদ্রিগো ফ্রেসান
সমকালীন আর্হেন্তাইন কথাসাহিত্যের আলোচিত লেখক রোদ্রিগো ফ্রেসানের জন্ম ১৯৬৩ সালে, বুয়েনোস আইরেসে। তাঁদের পরিবারকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে সামরিক জান্তা সরকার, রোদ্রিগোর বয়স তখন মাত্র ১০। ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে এসে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। কুজিন অ্যান্ড ভিনস নামের পানভোজনসংক্রান্ত ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন পাহিনা/১২ নামের সাহিত্য পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। ইস্তোরিয়া আর্হেন্তিনা (আর্হেন্তিনার কাহিনি, ১৯৯১) গল্পের বইটির জন্য ব্যাপকভাবে আলোচিত হন।
অনূদিত গল্পটির প্রেক্ষাপট ১৯৮৬ সাল। সেবার মেহিকোয় অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বকাপ এবং উল্লেখ্য, মারাদোনার নৈপুণ্যে সেবার কাপ জিতেছিল আর্হেন্তিনা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১০
Leave a Reply