চঞ্চল আশরাফ বিরচিত এবং ৪ জুন ২০১০ তারিখে প্রথম আলোর ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশিত ‘রবীন্দ্রনাথ কেন পড়ি কিংবা পড়ি না’ পাঠ করে মনে হলো, লেখক বাংলা সাহিত্যের বিশাল জায়গাজুড়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান এবং তাঁর সাহিত্যের প্রমূল্যকে অস্বীকার করতে চান। তিনি মন্তব্যের পর মন্তব্য করেছেন মূর্তিসংহারী উদ্দীপনা নিয়ে, এবং তাঁর কথাবার্তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সমকালীন নিন্দুকদের কণ্ঠ যেমন শোনা যায়, তেমনি সাম্প্রতিকতর সাম্প্রদায়িকদের বিদ্বিষ্ট উচ্চারণও অশ্রুত থাকে না। বাঙালি মধ্যবিত্তের ওপরও একহাত নিয়েছেন বেশ করে, এবং তাঁরই একজন প্রয়াত শিক্ষকের, দুর্মুখ বলে যাঁর খ্যাতি ছিল, অনুকরণে রবীন্দ্রগবেষকদের গালি দিয়েছেন রবীন্দ্রমন্দিরের পুরোহিত বলে। (স্মর্তব্য, সেই প্রয়াত মনীষী নজরুলগবেষকদের বলতেন নজরুলের মাজারের খাদেম।) খুব সাম্প্রতিককালে ভিন্ন একটি সাময়িক পত্রিকায়, শুনতে পাই, কালা-পাহাড়ি মন্তব্য করে গোটা একটা সিরিজ রচনা করেছেন তিনি। সেখানে পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে হালের তথাকথিত শূন্যের দশক পর্যন্ত কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে খামখেয়ালের তরী ভাসিয়েছেন বান্ধব-তোষণের বাঁকা খালে, বধ করেছেন অনেক ছোটবড় কবিকে। হাত পাকিয়েছেন কচুগাছ কেটে, এবার সবশেষে শাল্মলী তরুবরে হানতে চেয়েছেন কুঠার, যেন পণ করেছেন বাঙালিকে নিষ্ঠাকুর করে ছাড়বেন।
শুরুর বাক্যটিতেই রয়েছে চমক: ‘এটা ভেবে আমার খুব সুখ হয় যে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আমাকে কখনো আকর্ষণ করেনি, যেমন করেনি নজরুলের কবিতা।’ রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাঁকে কখনো আকর্ষণ করেনি, তা হতেই পারে। পৃথিবীর সবকিছু সবাইকে আকর্ষণ করে না। হোমারের মহাকাব্য, ডেভিডের সামগীতি, বিটোফেনের সুর, বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই, জোৎস্নারাত, শেক্সপিয়ারের নাটকে কোনো আকর্ষণ বোধ করেন না, এ রকম মানুষ পৃথিবীতে রয়েছে কোটি কোটি। কিন্তু তাই বলে এই আকর্ষণ না করাটা তাঁদের খুব সুখ দেয়, এ রকম কথাও সম্ভবত তাঁরা বলেন না। তাঁর পরের বাক্য, ‘আজ মনে হয়, খুব ভালো করে আমার মনে হয়, কবিতায় রবীন্দ্রনাথের অপচয় বিপুল, শামসুর রাহমানও অত অপচয় করেননি।’ প্রথমত, শামসুর রাহমানের রচনাবলি ও রবীন্দ্রনাথের রচনাসম্ভারের বিপুলতার তুলনা চলে কি না, তা চঞ্চলই ভালো জানেন, আর অপচয় কাকে বলেছেন তার ব্যাখ্যাও তিনি দেননি। চঞ্চল আশরাফ রবীন্দ্রসাহিত্যের উপল-উপকূলের ফেনাপুঞ্জই হয়তো দেখেছেন, অরূপরতন আশা করে তার রূপসাগরে ডুব দেওয়ার শক্তি, সাহস ও রুচি কোনোটারই ধারক তিনি নন। দূর থেকে হিমালয়কে দেখে বরফঢাকা মাটির ঢিবি এবং প্রকৃতির বিপুল অপচয় বলেই মনে হতে পারে অর্বাচীনের; শেরপার কাছে তার অর্থ ও মাহাত্ম্য ভিন্ন।
চঞ্চলের চপলতা ধরা পড়ে, যখন তিনি রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া তিনটি উপাধি যথা ‘বিশ্বকবি’, ‘কবিগুরু’ ও ‘চির-আধুনিক’ নিয়ে বাগিবস্তার করেন। বলেন, ‘কবিদের নামের সঙ্গে উপাধি জুড়ে দেওয়া বাঙালি মধ্যবিত্তের ধর্ম।’ তা জনাব চঞ্চল বোধ হয় জানেন না যে, এই দোষে আরও অনেক দেশের মানুষই দুষ্ট। যেমন, ওয়ার্ডসওয়ার্থকে ইংরেজরা উপাধি দিয়েছেন ‘প্রকৃতির কবি’, জন ডানেক ‘মেটাফিজিক্যাল’, উইলিয়াম ব্লেইককে ‘সন্ত’, টমাস গ্রেকে ‘গোরস্থানবিহারী’ এবং কিটসকে ‘ইন্দ্রিয়ঘনত্বের কবি’। তাই নজরুলকে ‘বিদ্রোহের কবি’ বা বিহারীলালকে ‘ভোরের পাখি’ উপাধি দিয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত এমন কোনো কবিরা গুনাহ করেছে বলে মনে হয় না। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের প্রতি সরল আবেগকে কপটতা বলেছেন চঞ্চল; বলেছেন, নোবেল পাওয়ার আগে সাহিত্যে তো বটেই, শিক্ষিত সমাজেও রবীন্দ্রনাথ লক্ষণীয়ভাবে স্বীকৃত ছিলেন না। অজ্ঞতাজনিত অবহেলা অনেক লেখকের কপালেই জোটে, এবং বড় ধরনের পুরস্কার পেলে লেখকের প্রতি পাঠকের মনোযোগ স্বাভাবিকভাবেই আকৃষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথকে চিনতে বাঙালি পাঠকের দেরি হয়েছে; তারা এত বড় প্রতিভাকে বুঝতে হিমশিম খেয়েছে; প্রথমত, শেষ পর্যন্ত তাঁর বিশ্বস্বীকৃতি যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করেছে, তখন বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো তাদের ভক্তি কলকলিয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছু লোক যে কখনোই রবীন্দ্রনাথের মহত্ত্ব ও বিরাটত্ব অনুধাবন করতে পারেনি, সে যুগেও না, এখনো না; তা চঞ্চলকে দেখেই বেশ বোঝা যায়। ‘বিশ্বকবি’ উপাধিটি যদি রবীন্দ্রনাথের জন্য অপ্রযুক্ত হয়ে থাকে, তবে ওটি আর কার কার প্রাপ্য, জানালে খুশি হওয়া যেত। রবীন্দ্রনাথের মাপের কবি সারা বিশ্বে বিরল; তাঁর সৃষ্টিবৈচিত্র্য, তাঁর দার্শনিক গভীরতা, তাঁর বাণীর সর্বজনীনতা, তাঁর মানবতাবোধ ও তাঁর বিশ্ববীক্ষা তাঁকে ওই উপাধির যোগ্যতা দিয়েছে। ‘নোবেল প্রাইজ’ না পেলেও ওই উপাধি তাঁর জন্য উপযুক্ত হতো। চঞ্চল, বিশ্বসাহিত্য থেকে একজন কবির নাম বলুন যিনি জীবনবোধের গভীরতায়, সৃষ্টির নৈপুণ্যে, বিবিধ জঁর যুগপৎ স্বচ্ছন্দ ও সফল ভ্রামণিকতায় রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ হতে পারেন। আধুনিকবাদী কবিতা জীবনের বাস্তবতাসমূহ তথা অমঙ্গলময়তা, অনিশ্চিতি ও আনিকেত্যতে মূর্ত করে প্রশংসনীয় কাজ করেছে বটে, কিন্তু এগুলোর রূপায়ণেই মানবজীবনের সকল দিক উদ্ঘাটিত হয়ে যায়, এ রকম ধারণা করা বালখিল্যতা। জীবনের নানা তল আছে, আছে স্বপ্ন, আছে দুঃখ-সুখের দোলদোলানো পৃথিবীর নানা তরঙ্গভঙ্গ, আস্তিত্বিক মানসিক জটিলতা, নানা আকাঙ্ক্ষা-সন্তাপ-পরিতাপ-সংক্ষোভ, দার্শনিক অনুভবের নানা প্রেক্ষা। মানবমনের জটিল উৎকাঙ্ক্ষার মধ্যে ঈশচিন্তাও একটি অচিকিৎস্য ‘ব্যাধি’, এক অসীম শূন্যতার কৃষ্ণগহ্বর, যার নাম মৃত্যু, তার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষকে আত্মজিজ্ঞাসা করতেই হয়। রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলিতে যদি ‘প্রভু, দেবতা আর প্রার্থনার প্রসঙ্গ’ এসে থাকে তাকে কুসংস্কার বা পশ্চাৎপদতা বলে গালমন্দ করা যায় হয়তো, কিন্তু মানবচিত্তের অনিবার্য আকুতিসমূহের মধ্যে এদের স্থান নগণ্য, এ কথা বলা যায় না। এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড, অ্যাশ ওয়েনেসডে ইত্যাদি তো ধর্মভাবিত কাব্য। তা সত্ত্বেও ‘আধুনিক’ হওয়া আটকায়নি তাঁর। রবীন্দ্রনাথের বেলায় ব্যতিক্রম হবে কেন? আধুনিকতার পরিধি ব্যাপক, সেখানে রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস, ফ্রস্ট এঁটে যান; অন্য দিকে আধুনিকবাদ রিডাক্টিভ ও এক্সক্লুসিভ, সেখানে বিশীর্ণ আকাশের নিচে বিবর্ণ জীবনের পালাকারদের বাইরে খুব বেশি লেখকের ঠাঁই হয় না। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক হওয়া সত্ত্বেও আধুনিক, যেমন ইয়েটস। তবে আধুনিকবাদকে তিনি গ্রহণ করেননি। সাহিত্যের পথে গ্রন্থের ‘আধুনিক কাব্য’ প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।
রবীন্দ্রনাথকে যদি ‘চির-আধুনিক’ বলা হয়ে থাকে, তবে তা ওই উদার বৃহত্তর অর্থে, সংকীর্ণ আধুনিকবাদী (মডার্নিস্ট) অর্থে নয়। আর চির-আধুনিক এই অর্থেও তিনি যে, তিনি ক্ল্যাসিকে রূপান্তরিত, তাঁর রচনার আবেদন কালের, সাম্প্রতিকতার সীমানা (দেশ-ভূগোলেরও) অতিক্রম করেছে। তিনি সর্বকালের, এবং চিরনতুন, যে অর্থে সকল চিরায়ত লেখক চিরকালীন ও চিরনতুন। যেমন হোমার, শেক্সপিয়ার কিংবা টলস্টয়। কবিতার ভাষা বদলেছে তিরিশের পর; এখনো বদলাচ্ছে, নিরন্তর বদলাবে। কিন্তু কিছু জিনিসের মূল্য ফুরায় না, সময়ের শত চংক্রমণে, শত মন্বন্তরেও যার আবেদন মানবমনের কাছে ফুরাবে না। অন্তত যত দিন জেনেটিক্যালি মডিফায়েড মানুষ এসে হাজির না হচ্ছে, তত দিন রবীন্দ্রনাথের রচনার আবেদন টিকে থাকবে। তাঁকে মনে হবে আমাদের মনের কথার কথাকার, আমাদের জীবনসত্যের অতুল্য মালাকার। শুধু কবিতায় নয়, তাঁর অসামান্য সব ছোটগল্পে, সর্বোপরি তাঁর গানে তিনি বাঁচবেন। এটা সত্য যে, রবীন্দ্রনাথের সকল রচনা ভবিষ্যতে টিকবে না; তাঁর রচনায় প্রচুর পুনরাবৃত্তি এবং অতিকথনও আছে। কিন্তু সারাৎসারটুকু বেঁচে থাকবে অনেক দিন। চিরদিন বলছি না, কেননা ওই চিরত্ব বলতে কী বোঝায়, তা আমার জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ কেন পড়ব? পড়ব এ জন্য যে, আধুনিক কবিতার পথ যেখানে শেষ, সেই মরুজ্বলা দগ্ধপ্রান্তরের শেষে স্বচ্ছতোয়া পিপাসানিবারি ঝরনার মতো দাঁড়িয়ে থাকবেন রবীন্দ্রনাথ, পথিককে ডাকবেন তাঁর ঝরনাতলার নির্জনে, যেখানে তাঁর গানের বাণী ঘনায়মান অন্ধকারে দেখাবে আশার আলো। চঞ্চল যা-ই ভাবুন, আগামী পৃথিবীতে অচিরকালের মধ্যে মানুষের দাঁড়ানোর জন্য কোনো পান্থপাদপ থাকবে না; আসছে শুষ্ক, কঠিন মরুঝড়, উটপাখির উন্মুখর অহং দিয়েও পরিত্রাণ মিলবে না। বাঙালি নয় শুধু, মানবজাতিরই প্রয়োজন হবে আশ্বাসবাণীর ছায়া; প্রতিষ্ঠিত ধর্মগুলোও যাবে শুকিয়ে; বেঁচে থাকবে কবিতার মতো কিছু ক্ষুদ্র আশ্রয়স্থল, যে রকম কবিতা রবীন্দ্রনাথ, হায়, একদা সৌভাগ্যবশত, লিখে গিয়েছিলেন, বেঁধেছিলেন একতারাটির একটি তারে মানবমনের অসহমধুর দুর্বহ বেদনার ভার।
খোন্দকার আশরাফ হোসেন
ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১০
Leave a Reply