রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [১৮৬১-১৯৪১] ১৫০তম রবীন্দ্রজন্মবর্ষ উপলক্ষে এ সময়ের একজন কবি, একজন কথাশিল্পী ও একজন চিত্রকরকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, কথাসাহিত্য ও চিত্রকর্ম নিয়ে লিখতে অনুরোধ করা হয়। সেই তিন রচনা নিয়ে এবারের আয়োজন।
আমার বাবা একদিন মলিন হয়ে যাওয়া তাঁর একটি গোপন খাতা আমাকে পড়তে দেন। এতে তাঁর প্রথম যৌবনের সাহিত্য-প্রচেষ্টার নমুনা আছে। আমি গভীর রোমাঞ্চ নিয়ে বাবার লেখা কবিতা, গল্প পড়ি। খাতাটি শেষ হয়েছে একটি গল্পে। গল্পটি এই রকম: বাবা টেবিলে বসেছেন একটি গল্প লিখবার আশায়। সামনে জানালা খোলা, আকাশে বিশাল পূর্ণিমার চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছেন বাবা, কিন্তু লেখার কোনো কূলকিনারা করতে পারছেন না। হঠাৎ দেখলেন, চাঁদের গায়ে যেন কিছু মনুষ্য-মূর্তি। ভালো করে লক্ষ করে দেখবার পর মানুষগুলোকে চিনতে পারলেন তিনি। দেখলেন, সেখানে একটি সভা হচ্ছে। সভার সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সভাসদ রয়েছেন বাংলা সাহিত্যের আরও বিশিষ্টজনেরা। ভালো করে কান পেতে শোনা গেল, সভার বিষয় হচ্ছেন আমার বাবা। রবীন্দ্রনাথকে সভাপতি মেনে এই বিশিষ্ট সাহিত্যজনেরা বিতর্ক করছেন, এই যে তরুণটি কাগজ-কলম নিয়ে জানালার পাশে বসেছেন বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশের আকাঙ্ক্ষায়, তাঁকে সে অনুমতি দেওয়া যায় কি না। তাঁরা সকলে এই অনভিজ্ঞ, অর্বাচীন তরুণকে সাহিত্য করবার অধিকার দেওয়ার বিপক্ষে। তাঁরা রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমার বাবা চাঁদের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে আছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত ঘোষণার ঠিক আগের মুহূর্তে পূর্ণিমার চাঁদটি ঢেকে যায় মেঘে। মেঘ কেটে গেলে বাবা দেখতে পান, গোল ঝকঝকে চাঁদ। সভা শেষে বিদায় নিয়েছেন সবাই। সে রাতে রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্তটি জানতে পারলেন না বলে আমার বাবা সাহিত্যচর্চা করবেন কি না, সারা জীবন এই নিয়ে দ্বিধান্বিতই থাকলেন।
২.
আমিও বাবার মতো জানালার পাশে লিখতে বসি, কিন্তু কখনোই পূর্ণিমা রাতে লিখি না। কে জানে, কখন মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন সেই বিখ্যাত সভাপতি? তাঁর লেখা, কাজকর্ম, ভাবনা ইত্যাদি মিলিয়ে এমন এক পাহাড় রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ যে এর পাদদেশে একটি হতবিহ্বল হরিণের মতো দাঁড়িয়ে হয় চূড়ার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকা যায় নয়তো খুব করে শিং দিয়ে গুঁতানো যায় পাহাড়ের গায়ে। দুটোই ঘটেছে তাঁর বেলায়। শরৎচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে লিখলেন, ‘তোমার দিকে চাহিয়া আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নাই।’ রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক বিস্তর লেখাপত্র বস্তুত এই কথাটিরই পুনরাবৃত্তি। আবার অন্যদিকে তাঁর জীবদ্দশায়, এমনকি মৃত্যুর পরও তাঁকে তুলোধোনা করা হয়েছে বিস্তর। নিজের সত্তরতম জন্মজয়ন্তীতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘এমন অনবরত, এমন অকুণ্ঠিত, এমন অকরুণ, এমন অপ্রতিহত অসম্মাননা আমার মতো আর কোনো সাহিত্যিককেই সইতে হয়নি।’ সমসাময়িক সাহিত্য-সমালোচকদের তীব্র তিরস্কারের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি, সানফ্রান্সিসকোতে উগ্র জাতীয়তাবাদীরা তাঁকে খুন করতেও উদ্যত হয়েছিল, নকশালের তুর্কি তরুণেরা ভেঙে ফেলেছে তাঁর মূর্তি। সেসব দিন অবশ্য গেছে। এখন মোটের ওপর সব শিক্ষিত বাঙালিরই রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক এক-একটি ব্যক্তিগত দেরাজ রয়েছে। কিছু গান, কবিতার কিছু পঙিক্ত, নাটকের কোনো সংলাপ, কয়েকটি গল্প, কোনো উপন্যাস, নির্ধারিত কয়েকটি প্রবন্ধ—এমনকি টুকরো টুকরো নিজস্ব রবীন্দ্রনাথ দিয়ে সাজানো সেই সব দেরাজ। সে রকম একটি দেরাজ আমারও আছে।
৩.
আমার দেরাজের জায়গা মূলত দখল করে আছে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য আর তাঁর গান। বিশ্বকবির কবিতা বরং সে তুলনায় আছে কম। ইয়েটসের কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি শুনে আপ্লুত অ্যান্ড্রুজ সারা রাত লন্ডনের রাস্তায় একা একা হেঁটেছেন। বিশ শতকের গোড়ার এলোমেলো ইউরোপে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রায় ঐশীবাণীর মতো মনে হয়েছে অ্যান্ড্রুজের। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় আজকের এই এলোমেলো পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে যখন সেই কবিতা পড়ছি, তখন কতিপয় ব্যতিক্রম ছাড়া সার্বিকভাবে আমার মনে ঠিক সেই একই অভিঘাত হচ্ছে, এমন দাবি করতে পারি না। যাঁর কবিতা পড়ে বাস্তবিক সারা রাত একা একা রাস্তায় হেঁটেছি তিনি রবীন্দ্রনাথ নন, জীবনানন্দ।
তবে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য তাড়িত করে নানা মাত্রায়। যদিও সেই কথাসাহিত্যে একজন কবিকেই দেখতে পাই চোরাগোপ্তা। কথাসাহিত্যিকের পক্ষে আদার ব্যাপারি হয়ে জাহাজের খবর নেওয়া দস্তুর। প্রবন্ধে গ্রামের ম্যালেরিয়া মহামারি থেকে শুরু করে সভ্যতার সংকট পর্যন্ত যাবতীয় বিষয়েই সক্রিয় দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের কলমকে। তাঁর এই সর্বব্যাপী কৌতূহলটি লক্ষ করি। লক্ষ করি, রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের বিষয় যত জটিল, গভীর হোক না কেন, তাতে টীকা-টিপ্পনীর পণ্ডিতি লতাগুল্ম থাকে না বলে ভাবনার ছিপ নৌকা বেশ তরতরিয়ে চলতে পারে। তিনি বলেছিলেন, সাহিত্যের মার্গ তিন রকম: কর্মকাণ্ড, জ্ঞানকাণ্ড আর রসকাণ্ড। নিজেকে মূলত রসের কারবারি হিসেবেই দাবি করেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে জ্ঞানকাণ্ডে তাঁর সক্রিয়তা একজন রসিক কবি হিসেবেই।
লক্ষ করি, রবীন্দ্রনাথ উপন্যাস আর নাটককে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর কালে অন্দরমহলে আর বাইরের পৃথিবীতে যা কিছু তোলপাড় ঘটছে, সেগুলোর সঙ্গে সাহিত্যিক মোকাবিলার মাঠ হিসেবে। নিজেকে ভেঙে ভেঙে তিনি বসিয়েছেন নিখিলেশ, সন্দীপ, অমিত, এলা, মধুসূদন, বিমলা, কুমু, নন্দিনী—এমনি আরও অনেকের মধ্যে। যদিও তাঁর উপন্যাসের সর্বদা বাকপটু, অভিজাত, বুদ্ধিদীপ্ত মিনিয়েচার রবীন্দ্রনাথ চরিত্রগুলোর সঙ্গে সব সময় ঘনিষ্ঠতা হয় না, তবু তাঁর এই কাল-ঘনিষ্ঠতাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখি। আর ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার ইট-সুরকি দিয়ে তিনিই তো প্রথম ছোটগল্পের দালান তৈরি করে দেখালেন। ইট-সুরকির মিশেল বদলে নানা নতুন গল্পপথে আমরা হেঁটেছি ঠিকই, তবু পড়তে শুরু করলে এখনো তাঁর অনেক গল্প টেনে নিয়ে যায় ভেতর ঘরে। স্নেহ, প্রেম, বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন জীবনকে ঘিরে ফেলবার আগে ‘অতিথি’ তারাপদের মতো পালাবার সাধ জাগে। সেই সঙ্গে এও লক্ষ করি, গল্পদাদুর মতো ভাষা তাঁর কাছে কেবল মজাদার কিসসাকে এগিয়ে নেওয়ার বাহন মাত্র নয়। শব্দ, বাক্য, কাহিনির একপরত ওপরের একটি ইশারা তিনি সব সময় রাখেন তাঁর গল্পে-উপন্যাসে। ‘গোরা’-তে বিছানার ওপর অচেনা মেয়েটির ফেলে যাওয়া রুমাল দেখে হঠাৎ বিনয়ের মনে আসে কিছুক্ষণ আগে রাস্তায় শোনা বাউলের গান, ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখী কমনে আসে যায়।’ চকিতে রুমালটি হয়ে ওঠে একটি মেটোনিম।
৪.
লক্ষ করি, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের শোভন সচেতনতাও। ‘শেষের কবিতা’য় নিজেই দাঁড়িয়েছেন নিজের বিরুদ্ধে। তরুণ বয়সে রানি ভিক্টোরিয়ার স্তুতিপত্র লিখলেও শেষ জীবনে মোহমুক্তি ঘটাতে দ্বিধা করেননি। লিখছেন, ‘জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্থ মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম য়ুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আজ আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ বৃহত্তর মানব ‘ঐক্য চেতনা’ কখনো কখনো তাঁকে শ্রেণী-অন্ধও করেছে। মুসোলিনিকে চিনতে ভুল করেছিলেন। ট্রানজিস্টারে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গান গাইতে শুরু করলে গ্রামের কৃষক এখনো ঘুরিয়ে দেন ট্রানজিস্টারের নব। সে সব জানা ছিল তাঁর, লিখেছেন, ‘আমার কবিতা জানি গেলেও বিচিত্রপথে হয় নাই সর্বত্রগামী।’
শুধু কবিতা নয়, কাঙ্ক্ষিত গল্প লিখতে না পারার আক্ষেপও তাঁর ছিল। গল্পলেখক বনফুুল তাঁর আত্মজীবনীতে লিখছেন, একদিন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে বলেছিলেন, একটি গল্প তাঁর ভাবনায় আছে, কিন্তু গল্পটি লেখা তাঁর জন্য সমীচীন হবে না বলে তিনি চান গল্পটি বনফুল লিখুন। গল্পটি এ রকম: এক যুবক নতুন বিয়ে করেছেন কিন্তু দিন যায় তিনি স্ত্রী সংসর্গ করেন না। সবাই ধারণা করেন, যুবকটি বুঝিবা কোনো ব্রত পালনের অংশ হিসেবে স্ত্রীগমন করছেন না। সাধু ভেবে সবাই তাঁকে শ্রদ্ধা করতে থাকেন। কিন্তু বাস্তবিক ঘটনা হচ্ছে, যুবক বিয়ের আগে বহুবার পতিতাগমন করেছেন এবং সিফিলিসে আক্রান্ত হয়েছেন। স্ত্রী সংসর্গ করলে স্ত্রীও এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন, এই বিবেচনায় তিনি স্ত্রীগমন থেকে বিরত আছেন। এই দ্বন্দ্ব নিয়েই গল্প। নিজের ভাবমূর্তির কথা ভেবে এ গল্প লিখবার সাহস পাননি রবীন্দ্রনাথ। এভাবে মনের ভেতর যা কিছু কিম্ভূত তাকে গোপন কোনো কুঠুরিতে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেকে অবিরাম ঢেকে রাখতে চেয়েছেন শোভনতায়। তাতে সব সময় স্বস্তি পেয়েছেন বলা যাবে না। শেষে সেই সব গোপন কিম্ভূতও বেরিয়ে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিগুলোতে।
৫.
সে বছর টমাস হার্ডির মনটা খারাপই হয়েছিল নিশ্চয়ই, জোরেশোরে কথা হচ্ছিল নোবেল পুরস্কার তাঁর ঘরেই যাবে। শেষে টেগোর নামের আলখেল্লা-পরা প্রাচ্যদেশীয় এক ‘একজোটিক’ কবি এসে নিয়ে গেলেন সে পুরস্কার। তাঁকে নিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে তোলপাড় তখন। আর্জেন্টিনায় ওকাম্পো, বোর্হেস, ফ্রান্সে আঁদ্রে জিদ, রমা রোলাঁ, জার্মানিতে ব্রেখট, রাশিয়ার পাস্তারনাক, চিলিতে নেরুদা মেতে উঠলেন তাঁকে নিয়ে। টেগোর নিয়ে এত মাতামাতিতে বিরক্তও হলেন অনেকে। টমাস মান, রার্ট্রান্ড রাসেল সে বিরক্তির কথা গোপনও রাখলেন না। লুকাচ তাঁর মার্ক্সবাদী অস্ত্র দিয়ে ঘায়েল করলেন রবীন্দ্রনাথকে। পশ্চিমাদের এসব উচ্চবাচ্য রবীন্দ্রনাথকে অবশ্য বিশেষ স্পর্শ করেনি। বরং পশ্চিমা মনীষীদের সঙ্গে যখন আলাপ হয়েছে, তখন পৃথিবীকে দেখবার চোখ যে তাঁর ভিন্ন, এটি বুঝিয়ে দিতে তিনি দ্বিধা করেননি। দেখি, কথোপকথনে এইচ জি ওয়েলস যখন মহা-উত্তেজনায় ভাষা-সংস্কৃতির বিশ্বায়নের কথা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ তখন তাঁকে স্পষ্টভাবে বিশ্বায়নের বিপদের দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছেন। আলাপে আইনস্টাইন যখন রবীন্দ্রনাথকে পদার্থ-জগতের নিত্যতার কথা বলছেন, রবীন্দ্রনাথ তখন প্রায় কোয়ান্টাম ফিজিসিস্টের মতো বলছেন পদার্থের অনিত্যতার কথা। পশ্চিমা পৃথিবী রবীন্দ্রনাথকে আধ্যাত্মিক সাধু ধাঁচের এক কবির তকমা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একসময় এ সাধুকে ভুলেও গেছেন তাঁরা। কিন্তু তাঁরা টের পাননি, এ এমন এক সাধু, যিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করবার জন্য টাকা জোগাড় করে বেড়ান, ছেলেকে আমেরিকা পাঠান কৃষিবিদ্যা শেখাতে, প্রেমের টানে চলে যান সুদূর আর্জেন্টিনা।
বহু বছর পর ‘গীতাঞ্জলি’র বাইরের বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথকে চিনবার নতুন উদ্যোগ এখন দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। দেখছি, নতুন করে তাঁর বিভিন্ন কথাসাহিত্য প্রকাশিত হচ্ছে ইংরেজিতে, প্রথমবারের মতো চীনা ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে সমগ্র রবীন্দ্র-রচনাবলী, সেদিন দেখলাম কানাডায় সন্ত্রাস-বিরোধী এক সম্মেলন শুরু হচ্ছে রবীন্দ্রনাথে পঙিক্ত দিয়ে, আমস্টার্ডামের টেগোর রেস্টুরেন্টে বসে স্লোভানিয়ার বন্ধু বলছেন, তাঁর শহরে ঢুকবার মুখে দেয়ালে খোদাই করা আছে রবীন্দ্রনাথের বাণী, শান্তিনিকেতনকে ইউনেসকো বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করতে যাচ্ছে এ বছর। ব্যাপক, বর্ণাঢ্য সৃজনশীলতায় এই যে বিড়াল এবং বিড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরটিকে একই সঙ্গে বিহ্বল করার ক্ষমতা, এ শুধু নোবেল পুরস্কারের ব্যাপার নয়। রবীন্দ্রনাথের সৃজনশীলতা কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবে, সেটা নির্ভর করবে আমাদের নিজেদের সৃজনশীলতার ওপর।
৬.
মেয়ে মীরার স্বামী নগেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথকে জ্বালিয়েছেন বেশ। তাঁকে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘তোমার মনে যখন কোন গ্রন্থি পড়ে তখন দেখেছি সেটাকে টেনে টেনে তুমি শক্ত করে তোলো, তুমি ভুলতে জানো না…শুধু নিজের কথা ভাবতে গেলেই দুঃখের অন্ত থাকবে না, কারণ এই নিজের কথাটিই হচ্ছে আমাদের শাস্ত্রে যাকে বলে মায়া। এই তো বুদ্বুদ, এই তো কুয়াশা…হূদয়ের নিভৃত স্থানকে অনাবৃত করার দ্বারা তাকে humiliate করিয়ে তারপর যদি ক্ষমা করো তাহলে সে ক্ষমার মূল্য নেই। সংসারে আমরা সকলেই কোন না কোন অপরাধের শাস্তি না পেয়ে ক্ষমা পেয়েছি অথচ কবুল করিনি…’ আমার এক ঘনিষ্ঠজনকে ঠিক এ কথাগুলোই বলতে চেয়েছি। কৌশলে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি পড়ে শুনিয়েছি।
ধর্ষিতা এক পোশাক-শ্রমিক নিয়ে একটি গল্প লিখেছিলাম। নিজের অলক্ষে দেখি, কখন গল্পের নাম দিয়ে রেখেছি, ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত’। রবীন্দ্রনাথের এই গানটির মূল ভাবনার সঙ্গে আমার গল্পটির কোনো মিল নেই। তবু মনে হয়েছে, এর চেয়ে যথার্থ আর কোনো নাম গল্পটির হতে পারে না।
তুষারপাতের মধ্যে বিলেতের এক বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি রাতের বেলা। আমার কানটুপি আর ওভারকোটের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকছে হু হু হিম হাওয়া। সাদা হয়ে উঠেছে চরাচর। বিদেশ বিভুঁইয়ে হঠাৎ কেমন নিরালম্ব বোধ করি। আর ঠিক তখনই মনের ভেতর জেগে ওঠে:
আমার তরী ছিল চেনার কূলে
বাঁধন যে তার গেল খুলে
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে এলো কোন অচেনার ধার।
আমার বাবার নিয়তি এড়াতে পারি না। যতই পূর্ণিমা চাঁদকে এড়িয়ে চলি না কেন, ঘোর তুষারপাতের ভেতরও দেখি, উপস্থিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৪, ২০১০
Leave a Reply