রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্ম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের সৃষ্টির ঝরনাধারায় বয়ে আসা বিপুল পরিমাণের ছবি (প্রায় আড়াই হাজার) কিছুটা রহস্যময়। ছবিগুলো আঁকা হয় ১৯২৫ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে। যে কবি সারা বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছেন, তিনি কিসের তাড়নায় দৃশ্যশিল্পে অবশেষে মনোনিবেশ করলেন? উত্তর হতে পারে, সব শিল্পের উদ্দেশ্য এক হলেও প্রতিটির ভাষা ভিন্ন, স্বাদ আলাদা, প্রকাশ পৃথক। শব্দে যা প্রকাশিত হয়, রং ও রেখায় তা হয় না ঠিকই—তবে যা হয়, তা শব্দে হয় না; হয় রূপসৃষ্টির-দৃশ্যরূপ।
জীবনসায়াহ্নে যখন তাঁর অফুরন্ত সৃষ্টিশক্তির স্ফুরণ ঘটেছে নানান দিকে, তখন কবি নিজের কথাতেই যে কাজে তাঁর দক্ষতা নেই, সে কাজেই মন দিলেন। প্রাথমিক পর্বে পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিকে সৌন্দর্যদানের জন্যই ছবি তৈরির কাজ শুরু। সেই থেকে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা আলো-আঁধারি রূপের প্রকাশ। কারুদক্ষ না হলেও কবির মানস পরিপক্ব, আলোকিত, ধারণা সুস্পষ্ট, বিশ্বের নানা দেশের শিল্পের বিভিন্নতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁকে দিয়েছিল শিল্পকে নিজের মতো করে বুঝে নেওয়ার প্রত্যয়। তাঁর ছবিতে যে অপটু-দক্ষতা লক্ষণীয়, তা ছবিগুলোকে দিয়েছিল পাশ্চত্যের পণ্ডিতদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা। কারণ, আধুনিকতা তো পাশ্চাত্যের শিল্পের বাঁধাধরা গণ্ডি থেকে নিষ্কৃতি পেতে বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে সন্ধান করছিল এই তথাকথিত ‘আদিমতা’ গুণ। কবি তাঁর পরিপক্বতায় সংশ্লেষ ঘটাতে পেরেছিলেন তাঁর অভিব্যক্তি, বিশ্বশিল্পের সার গ্রহণ করে তার নির্যাস, চিত্রে রূপ দিয়েছিলেন তাঁর অপ্রকাশিত অবচেতনকে একান্ত সততার সঙ্গে প্রকাশ করে।
এর পেছনে একটি কারণ হতে পারে যে ছবির ভাষায় তাঁর ওপরে কোনো চাহিদার বা উচ্চাশার চাপ ছিল না। তিনি স্বয়ং যে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন, সেটার আবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হয়ে দেখা দিল ছবি আঁকা। কবির সংস্কৃতি অঙ্গনে ব্যক্তিত্বের বিশাল বিস্তৃতি এবং সর্বময় উপস্থিতি হয়তো ছবি আঁকার ক্ষেত্রটিতে কবির কাছে নিজেকে অনুসন্ধান করার নতুন ও অনাবিষ্কৃত একটি উপায় তৈরি করে দিয়েছিল। এ ক্ষেত্রটিতে কোনো পর্বতসম প্রত্যাশার চাপ থেকে তিনি মুক্ত, যার সীমারেখা অস্পষ্টায় মোড়া। নিগূঢ় অর্থে, ছবিতে বিষয় ও আঙ্গিকের ঐকতান আবশ্যক এবং একমাত্র ছবির রচয়িতাই এ ঐকতানের রূপ নির্ধারক। তদুপরি কবি একই সঙ্গে এক ধরনের অভিজাততান্ত্রিকতায় নিরাপদ। তবে রবীন্দ্রনাথের ছবিতে প্রকাশ পেয়েছে অকৃত্রিম সততা, যা কি না তাঁর ছবিকে দিয়েছে অনন্যতা। তাই যেমন অজানা কোনো প্রস্তর যুগের মানবের আঁকা চিত্র আমাদের নাড়া দেয়, ঠিক তেমনই রবীন্দ্রনাথের ছবিও প্রতীকী ভাষা ও প্রকাশ-সততা দিয়ে মানবচিত্তকে স্পর্শ করে। এর আবেদন মার্জিত-গ্রহণযোগ্য কোনো পরিচিত রীতি নয়, বরং এর বলিষ্ঠ প্রকাশ-সততা, যা ব্যাকরণ-প্রকরণের ঊর্ধ্বে। চিত্রগুলো যেন কোনো প্রয়োজনের তাগিদেই সৃষ্ট, শখে নয়।
এটাও সত্য যে রবীন্দ্রনাথের প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প-শিক্ষার অভাব তাঁকে মুক্ত করেছিল ‘শিক্ষিত শিল্পীর’ কোনো বিশেষ শিক্ষার বেড়াজাল থেকে। শুধু প্রশিক্ষিত শিল্পীই জানেন, প্রশিক্ষণ যে কী বাধা হতে পারে প্রকৃত অকৃত্রিম প্রকাশের পথে। কত কষ্টে যে তাকে বের হতে হয় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা ধার করা কোনো শিল্প-ব্যাকরণ ও ভাষা থেকে। রবীন্দ্রনাথের ছবি যেমন এদিক থেকে মুক্ত, তেমনই এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কবির অভিজ্ঞতা, শিল্প ও নন্দনতত্ত্বের বিষয়ে চিন্তা ও ধারণা, নানা দেশের, না যুগের শিল্পের রীতি ও শৈলীর সঙ্গে তাঁর পরিচিতি। তাঁর অপ্রশিক্ষিত নির্ভীক পথচলার একটি পটভূমিও ছিল। নব্য-বঙ্গীয় ধারার চিত্রচর্চা যখন কিছু রীতি, শৈলী ও বাঁধাধরা বিষয়বস্তু নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে, তখন রবীন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ ও দুঃসাহসিক সততা তাঁকে নিয়ে গেছে বাইরের রূপ ও শৈলীর সন্ধানে নয়, বরং তাঁর সচেতন-অবচেতনের মাঝে একান্তই নিজের সারসত্তায়, যেখানটিতে ছাড়া বাকি সবটাই মানুষের অনুমানের, অপ্রত্যক্ষ। সে কারণে রবীন্দ্রনাথ এ ভূখণ্ডে আধুনিক শিল্পের পুরোধা বলে বহুল স্বীকৃত। তাঁর ছবি প্রতীকীবাদ ও অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর ছবি তাঁর একান্তই নিজের।
ছবির বিষয় হিসেবে কবি বেছে নিয়েছেন প্রতিকৃতি, প্রকৃতি, জীবজন্তু ও মানব অবয়ব। সবাই তাঁর নিজের মতো করে, নিজের তাগিদে মাধ্যম ও প্রকরণ—সবই তিনি প্রয়োজনে প্রয়োগ করেছেন। প্রকাশ ও মাধ্যমের মাঝে দূরত্ব তিনি মেনে নেননি। সবশেষে বলতে হয়, শিল্প জীবনের উচ্ছিষ্ট নয়, শিল্প তখনই অর্থবহ এবং সফল, যখন তা হয় জীবনসংলগ্ন, এমনকি জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। ধরে নিতে পারি, রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষাংশে যে ছবির জগতে নিমগ্ন হওয়া, সেটা কবির একান্ত ব্যক্তির প্রয়োজনের তাগিদে। কারণ জাগতিক কোনো প্রাপ্তিলাভের কোনো অভাব তাঁর ছিল না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৪, ২০১০
Leave a Reply