একত্র হওয়া আর একাত্ম হওয়া এক নয় ঠিকই, তবে এ দুয়ের মধ্যেই দুধরনের আনন্দ আছে। কখনো স্ব-উদ্যোগে, কখনো বা গ্যালারির আহ্বানে শিল্পীরা যখন কোনো যৌথ প্রদর্শনীতে সমবেত হন, তখন এই দুয়ের ব্যবধানের বিষয়টি অবশ্য উপলব্ধি করা যায়। ওই সব যৌথতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্পীদের অঙ্কনরীতি ও চিত্রভাষার বাহ্যিক ঐক্যকে মান্য না করলেও তা যে বিচিত্রতার সমাহার ঘটায়, তা দর্শককে এক প্রকার আনন্দের আস্বাদ নিতে সহায়তা করে।
বেঙ্গল শিল্পালয় তাদের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘সৃজনে ও শেকড়ে’ শিরোনামে ১০ জন করে শিল্পীর ১০টি প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনা করেছে। ১৮ থেকে ২৯ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো তারই দ্বিতীয় প্রদর্শনী। এর শিল্পীরা হলেন সমরজিৎ রায়চৌধুরী, আবদুল মুক্তাদির, কালীদাস কর্মকার, শহীদ কবির, আবদুস শাকুর শাহ্, কাজী গিয়াসউদ্দিন, ফরিদা জামান, মোহাম্মদ ইউনুস, রোকেয়া সুলতানা ও ঢালী আল মামুন। ষাট, সত্তর ও আশি—এই তিন দশকের শিল্পী এঁরা। সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তাঁদের প্রত্যেকেরই রয়েছে নিজস্ব শিল্পভাষা। প্রত্যেকেরই চারটি করে চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে, যার অধিকাংশই এ বছরে আঁকা। বাকিগুলোও নিকট অতীতের। এসব চিত্র থেকে শিল্পীদের সাম্প্রতিক কর্মবৈচিত্র্যের পরিচয় লাভ করা যায়।
তাঁদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শিল্পী সমরজিৎ রায়চৌধুরীর শিল্পকর্মে নতুনত্বের ব্যঞ্জনা আছে। আছে তাঁর নিষ্ঠা ও চিন্তার গভীরতা। তাঁর ছবি নকশাগুণে সমৃদ্ধ। রঙের বিন্যাসেও তিনি মিনিমাইজেশনের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর চারটি ছবির চারটি মাত্রা। কিন্তু একটি দিকে মিল হলো নানা ইমেজ ও মোটিফের মাধ্যমে তিনি সব ছবিতেই এক প্রকারের শিশুতোষ নির্মল আনন্দ সঞ্চার করতে পেরেছেন। ‘এসেন্স অব হারমনি’ চিত্রটিতে তিনি নির্মাণ করেছেন সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির এক প্রতীকী ভাষ্য।
আবদুুল মুক্তাদির অনেকটা ধ্যানী শিল্পী। তাঁর মধ্যে একধরনের আত্মসমাহিতের ভাব আছে, যা তাঁর চিত্রতলকেও দিয়েছে প্রশান্তির দ্যোতনা। তাঁর পুষ্প ও বৃক্ষবন্দনার মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে শিল্পীর আত্মমগ্ন মৌন ভাবময়তা।
কালিদাস কর্মকার পাললিক কালোর মধ্যে দেশমৃত্তিকাকে অনুসন্ধানের পাশাপাশি সঞ্চার করেন নানা রূপক-প্রতীকের ব্যঞ্জনা। প্রতীকী কাঠামোয় তিনি উপস্থাপন করেন নানা তান্ত্রিক-পৌরাণিক অনুষঙ্গ। তিনি দর্শকচিত্তকে রসসিক্ত করার পরিবর্তে চমৎকৃত করতেই বেশি আগ্রহী।
স্পেনপ্রবাসী শহীদ কবিরের চিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ হলো প্রাণবন্ততা। তিনি মানুষ, জীবজন্তু কিংবা প্রকৃতি যা-ই আঁকেন, তার মধ্যে প্রাণসত্তার জাগরণে বিশেষভাবে উন্মুখ হয়ে ওঠেন। এই উন্মুখতা থেকেই তিনি রং ব্যবহারে উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ঘটান। প্রদর্শিত পুষ্পবিষয়ক তিনটি চিত্রেই তিনি পাথরের গুঁড়ো মিশিয়ে রঙের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি করেছেন। অন্যদিকে বস্তিসুন্দরীর দেহবল্লরীর ছন্দময়তার মধ্যে সঞ্চার করেছেন ভিন্নতর প্রাণরস। তাঁর সবচেয়ে সার্থক চিত্রটির নাম ‘রক্তজবা’, যেটি পুরো প্রদর্শনীর চিত্রমালার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ চিত্রের বিরচন কৌশলটিই অসাধারণ। একটিমাত্র ফুলকে নিয়ে চিত্রপরিকল্পনার মধ্যে শিল্পীর সাহস ও দক্ষতার পরিচয় আছে।
আবদুস শাকুর শাহ্ দীর্ঘদিন যাবৎ মৈমনসিংহ গীতিকার কাহিনি নিয়ে ছবি আঁকছেন। লোকসাহিত্যের বিষয়কে শিল্পের অঙ্গীভূত করায় শিল্পবোদ্ধাসহ দেশি-বিদেশি ক্রেতা মহলে তিনি জনপ্রিয়। এ প্রদর্শনীর চারটি চিত্রের বিষয়েও রয়েছে মহুয়া, কমলা ও কাজলরেখার আখ্যান। দীর্ঘদিন ধরে একই বিষয়কে অবলম্বন করে চিত্র রচনা করলে শিল্পীকে একধরনের বিষয়ের মায়ায় জড়িয়ে পড়তে হয়। আবর্তিত হতে হয় একই ধরনের রূপকল্পের মধ্যে। নিজেরই রচিত বৃত্ত থেকে বের হওয়া তখন বেশ কষ্টসাধ্য। তবে আত্ম-অতিক্রমণের আগ্রহ তাঁর মধ্যে আছে।
জাপানপ্রবাসী কাজী গিয়াস বরাবরের মতোই চিত্রতলকে সজ্জিত করেছেন পরম নিষ্ঠায়। তাঁর অভিনিবেশ অসাধারণ। তিনি চিত্রতলের প্রতিটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও ভরাট করে তোলেন তাঁর স্বকীয় পদ্ধতির টেক্সচারের মাধ্যমে। শিল্পী হিসেবে তিনি পরিশীলনপ্রিয়। জীবনানন্দ দাশের মতোই প্রখর উজ্জ্বলতা তাঁকে আকৃষ্ট করে না। বরং তিনি কোমলতাপ্রিয়। রং ব্যবহারে তাঁর এই শুদ্ধতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যে সংযম, তাতে তাঁর চিত্রের সামনে দাঁড়ালে দর্শকচিত্ত একধরনের প্রশান্তিতে আবিষ্ট হয়। ‘মিথ-১’ শীর্ষক চিত্রটিতে তিনি আভাসিত করে তুলেছেন নানা পৌরাণিক চরিত্রের হালকা সাদার বহির্রেখানির্ভর আবয়বিক কাঠামো।
আনন্দে হিল্লোলিত সুফিয়াকে নিয়ে ফরিদা জামানের আঁকা চারটি চিত্রেই রঙের ভিন্নতর বিন্যাস সত্ত্বেও একটিমাত্র বাস্তবতা দর্শকমনকে বিভোর করে তোলে। তা হলো: নারীর মুক্তি-সংক্রান্ত উচ্ছ্বাস। এই মুক্তি নারীকে পরিণত করে বিহঙ্গে। সে তখন ভারমুক্ত, ওজনহীন; শরীর থেকে খসে পড়েছে তার সব মেদ-মাংস; বাতাসে কিংবা পানিতে ভেসে বেড়ানোর মতো উপযোগী সে। তাঁর সব চিত্রেই উচ্চকিত হয়েছে
নারীমুক্তির সাংগীতিক ব্যঞ্জনা।
মোহাম্মদ ইউনুস রঙের বিন্যাস ও বিরচনগত কৌশলের মাধ্যমে তাঁর চিত্রতলকে অর্থবহ করে তুলতে চান। এ ক্ষেত্রে তিনি বিচিত্রধর্মী টেক্সচারকেও এই অর্থবহতার উপযোগী করে তোলেন। চিত্রভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাব্যিক নামকরণের ঝোঁক যেমন তাঁর মধ্যে আছে, তেমনি আছে বাস্তবতার সংকটকে চিত্রতলে রূপায়িত করারও আগ্রহ।
রোকেয়া সুলতানার অন্তর্গত অনুভূতিতে নানা রকম রক্তক্ষরণ আছে। মানুষের অচেতন-অবচেতনের নানা অপ্রকাশ্য অবদমিত আকাঙ্ক্ষা, বেদনা ও যন্ত্রণাকে তিনি রঙের বিচিত্র ভাষায় পরস্ফুটিত করেন। ফলে তাঁর, চিত্রে স্নানদৃশ্যের পটভূমিতেও অন্বিষ্ট হয় লালের রক্তিমাভা। অনুভূতিময়তার শিল্পী তিনি। অনুভূতির সংরাগকে স্মৃতিরসে জারিত করে তিনি তাঁর চিত্রকে করে তোলেন অনুভববেদ্য।
ঢালী আল মামুন এ প্রদর্শনীর শিল্পীকুলের মধ্যে বয়ঃকনিষ্ঠ হলেও কনসেপ্টের দিক থেকে গভীরতাসন্ধানী। তিনি তাঁর সৃজনশীলতার সঙ্গে মননশীলতার একটা সমন্বয় ঘটিয়েছেন। এই সমন্বয়ের ফলেই তাঁর চিত্রের বিরচন-কৌশল, ইমেজ ও মোটিফের ব্যবহার বহুমাত্রিক অর্থবহতা লাভ করে, যা দর্শককে সহায়তা করে ভাবনার গভীরে প্রবেশে। তাঁর সাদা-কালোর ড্রইং কিংবা রঙিন তেলচিত্র উভয় ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৪, ২০১০
Leave a Reply