প্রথম আলোর ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে আমার কবিতার বই অস্ত্রে মাখিয়ে রাখো মধু নিয়ে আলোচনা ছাপা হয়েছে গত ১৪ মে। আলোচক আহমেদ মুনির। আলোচনাটি পড়ার পর মনে হলো এতে এমন অনেক ভুল আছে, যা আমার বইটি সম্পর্কে পাঠককে বিভ্রান্ত করবে। এ ভুলগুলো যে আলোচকের ইচ্ছাকৃত তা হয়তো নয়, হতে পারে সেগুলো তাঁর চোখ এড়িয়ে গেছে। তাই আলোচকের সমালোচনা করতে নয় বরং বিভ্রান্তিগুলো দূর করতেই এই আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক রচনা।
প্রথমেই বলি, প্রচ্ছদের নিচের পরিচিতিতে একটি ভুল আছে, তা হলো আমার বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৮। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ৬৪। এ ভুলটি সম্ভবত সম্পাদকের।
আলোচক তাঁর আলোচনায় আমার কবিতা থেকে ছয়টি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যার মধ্যে পাঁচটি উদ্ধৃতিতেই ভুল! এর ফলে শুধু অর্থবিভ্রাটই ঘটেনি, ছন্দও পতিত হয়েছে। এখানে আমি শুধু ভুল লাইনগুলো শুদ্ধ করে দিতে চাই। প্রথমে ভুলটা তুলি, পরে শুদ্ধ করি।
আছে: ‘আমাদের কাব্যগুলো কোন অর্থ পাবার আগেই/ পরিণত হচ্ছে কুয়াশায়।’ (‘কুয়াশা’)
হবে: ‘আমাদের বাক্যগুলো কোনো অর্থ পাবার আগেই/ পরিণত হচ্ছে কুয়াশায়।’
আছে: ‘সেথায় যায়া দেখি আমি ছেলের হাতে মোয়ারে।’ (‘উন্নয়নমূলক গান’)
হবে: ‘সেথায় যায়া দেখি আমি ছেলের হাতের মোয়া রে \’
আছে: ‘কত শব্দ হদিসও রাখে নি তার, দ্যাখো’ (‘কত শব্দ’)
হবে: ‘কত শব্দ হদিসও রাখেনি তার, দ্যাখো’
আছে: ‘কী জানি কী হইছে আমার/ …বলে আমারে একলা পায়া’ (‘দুইজনাতে বুদ্ধি করি’)
হবে: ‘কী জানি কী হইছে রে আমার/ …বলে আমায় একলা পায়া’
আছে: ‘তুমিই আপন আমিই পর/ তবু’ (‘পঞ্চগড়’)
হবে: ‘তুমি আপন, আমিই পর,/ তবু’
এই হলো বাস্তবতা। যাক, এরপর আলোচক বলছেন, ‘কাব্যগ্রন্থটিতে ৪০টি কবিতা।’ আসলে তা নয়। বইটি দুটি পর্বে বিভক্ত। দ্বিতীয় পর্বের নাম ‘ডাঙার ওপর দুলছে তোমার নাও’। এই পর্বটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কিছু কবিতা নিয়ে। প্রথম পর্বে ৩৯টি, দ্বিতীয় পর্বে নয়টি—মোট ৪৮টি কবিতা আছে বইটিতে। আর বইটি যে দুটি পর্ব নিয়ে গঠিত, এটা উল্লেখ না করার ফলে বইটির একটি বৈশিষ্ট্য অনুল্লিখিতই থেকে গেছে।
আলোচক বলছেন, ‘তিনি ছন্দ ভালোই জানেন কিন্তু ছন্দ নিয়ে খুব একটা নিরীক্ষার দিকে যাননি।’ এবার কিছুটা আত্মপ্রশংসার মতো শোনালেও আমাকে বলতে হচ্ছে, একটু লক্ষ করলেই বইটিতে ছন্দ নিয়ে নিরীক্ষার উদাহরণের কোনো অভাব হতো না আলোচকের। অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত—প্রচলিত তিনটি ছন্দে লেখা কবিতাই আছে বইটিতে। আছে স্বরবৃত্তের বিরল উদাহরণ—খণ্ড পর্ব ছাড়া শুধু ৩/৩/৩/৩…চালের কবিতা ‘অন্তরায়’। আছে একই কবিতায় গদ্য, অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সূক্ষ্মভাবে পরস্পর একাকার হয়ে যাওয়ার উদাহরণ ‘পঞ্চগড়’। উদাহরণ আরও অনেক আছে, তাই ক্ষান্ত হলাম।
আলোচকের ভাষ্য, ‘অন্ত্যমিলের প্রতি নিদারুণ আসক্তি তাঁর। চারণকবিদের মতো প্রতি বাক্যেই অন্ত্যমিল রাখার চেষ্টা করেছেন।’ লাইন দুটি পড়ে মনে হবে, বইটিতে অন্ত্যমিল ছাড়া কোনো কবিতাই নাই। অথচ সত্যি বলতে কি, আমি ‘চারণকবিদের মতো প্রতি বাক্যেই অন্ত্যমিল রাখার চেষ্টা’ করেছি মাত্র তিন থেকে চারটি কবিতায়। অন্যান্য কবিতায় আছে প্রথমের সঙ্গে তৃতীয়, দ্বিতীয়ের সঙ্গে চতুর্থ বাক্যের মিল। আছে প্রথমের সঙ্গে চতুর্থ, দ্বিতীয়ের সঙ্গে পঞ্চম ও তৃতীয়ের সঙ্গে ষষ্ঠ বাক্যের মিল ইত্যাদি। আর আছে অন্ত্যমিলবিহীন ২০টি কবিতা।
আমার কবিতা বিষয়ে আলোচকের মতামত নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না, সেটা অশোভন লাগে। শুধু বলব, তাঁর কিছু বাক্য আমি বুঝতে পারিনি নিজেরই অক্ষমতাবশত।
আহমেদ মুনির এক জায়গায় বলেছেন, ‘…একটু মনোনিবেশ করলে তাকে বোঝা অসম্ভব নয়। আবিষ্কার করা যাবে এক নতুন কাব্যভূমি।’ আলোচকের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলি, তিনিও একটু মনোনিবেশ করে, যত্ন নিয়ে কবিতার বইয়ের আলোচনা করবেন, তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা এতটুকুই। কেননা আমি জানি, কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করাটা কতটা জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। এর পরও আহমেদ মুনির যে কবিতার বই নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন, এ সাহসের জন্যই তাঁকে ধন্যবাদ।
ফিরোজ এহেতশাম
মণিপুরিপাড়া, ঢাকা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৪, ২০১০
Leave a Reply