কাজী নজরুল ইসলাম ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে?’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে এ-জিজ্ঞাসাটি কার উদ্দেশে করেছেন জানি না। হয়তো এমনি, কবির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হিসেবে; কিংবা হয়তো তা নয়, মনে হয়তো কোনো শিল্পী ছিলেন। তবে যে শিল্পী নজরুল নন; আর কাব্য নামের জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী হতে পারেন। নামটি চমৎকার, তাৎপর্যমণ্ডিত ও (প্রতীকময়) নজরুলের স্বভাব, বৈশিষ্ট্য ও কর্মের সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই। নজরুল নিজেই তো অগ্নিবীণা। অগ্নিদীপ্ত বাণী ও সুর তো তিনিই। তারই হলকায় পুড়ে যায় ঔপনিবেশিক শাসন-ত্রাসনের আসন। বেজায় বিচলিত ব্রিটিশ সরকার অত্যাচার-নিপীড়নের পথ ধরল, নিষিদ্ধ করল বিশের বাঁশী, ভাঙার গান, প্রলয়-শিখা, যুগবাণী, রুদ্রমঙ্গল—সবগুলোই তো কালের অগ্নিবীণা; সমকালের শোণিতে অগ্নিপ্রবাহ-তীক্ষ জ্বালাময়, মহাবিস্ফোরক ও অগ্নিউদ্গারী। নজরুলের অগ্নিব্রত দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, পরদেশির শাসনে অত্যাচারিত, উৎপীড়িত ও অসহায়ের জন্য, ধনিক শ্রেণীশোষিত নিম্ন কোটির জনমানুষের জন্য। নজরুল উপনিবেশের আমলের লোক, জন্মেছিলেন গরিব ঘরে, কিন্তু বেড়ে উঠেছিলেন নিখাদ দেশচেতনা নিয়ে। দেশের অধীনতা তাঁকে খুব পীড়া দিয়েছিল। দেশ বলতে সেই সময়ের অখণ্ড অধীন ভারত উপমহাদেশ, তেত্রিশ কোটি লোকের বাস। তাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে যে শাসক-শোষক তাদের বিরুদ্ধেই তাঁর জীবনব্যাপী সংগ্রাম ও তাঁর সকল বিদ্রোহ। সুতরাং নজরুলের কথাগুলো পরশাসন-শৃঙ্খলিত অখণ্ড ভারতকে নিয়েই। সেইটিই অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর রচনায়, ক্ষেত্রবিশেষে গল্পে ও উপন্যাসেও, তবে বিশেষ করে কবিতায় ও গানে এবং অবশ্যই নবযুগ-ধূমকেতুর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয়তে। ‘ধূমকেতুর পথ’ নামের সম্পাদকীয়-নিবন্ধটিতে পরশাসনের শিকল ছিন্ন করার বজ্রশপথদীপ্ত নজরুল নির্দ্বন্দ্ব উচ্চারণে জানালেন।
সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশির মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়মকানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা-নিষেধের বিরুদ্ধে। আর এই বিদ্রোহ করতে হলে—সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে—
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।
সমকালে উপযুক্ত কথাগুলোই কাব্যিক অভিপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর সবচেয়ে সুপরিচিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’তে। আত্মবোধনের উন্মাদনায় নিজের স্বাধীনসত্তার উপলব্ধি এ কবিতায় যতভাবে ঘটেছে, অন্য কবিতাতে তত নয়। এ কবিতাতেই চিরবিদ্রোহীর মহাউত্থান ঘটেছে, কাউকে কুর্নিশ না করার কথা বলা হয়েছে এবং এভাবে স্বাধীনসত্তার চিরকালীন মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নজরুল তাঁর প্রথম কাব্য অগ্নিবীনা উৎসর্গ করলেন বিপ্লবী রাবীন ঘোষকে, অগ্নি-ঋষি সম্বোধন করে। নজরুল বিপ্লবী মন্ত্রের সবক নিয়েছিলেন কৈশোর-উত্তীর্ণ কালে। সেই মন্ত্রের আগুন ছড়িয়ে পড়ল তাঁর প্রথম দিকের রচনায়, পদ্য-গদ্য উভয়াংশে। নজরুল অগ্নিযুগের কবি, স্বাধীনতার আগুন-তাতা বিপ্লবী বিদ্রোহী মন্ত্রের সৈনিক। আগুন নিয়েই তাঁর খেলা। আগুন নিয়েই তাঁর কাজ। কবিতার পথে হাঁটবেন তিনি ওই আগুনের ঝান্ডা হাতে। নজরুলের দৃষ্টিতে ধূমকেতু হলো আগুনের পতাকা। বললেন, ‘দেশের পক্ষে যা মঙ্গলকর বা সত্য, শুধু তাই লক্ষ্য করে এই আগুনের ঝাণ্ডা দুলিয়ে পথে বাহির হলাম’ (আমার পথ)। অন্যদিকে ‘ধূমকেতু’কে তুলনা করলেন ঝাঁটার সঙ্গে; তবে অচিরেই বোঝা গেল সেটিও অগ্নি-সম্মার্জনী। —‘দেশের যারা শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে “ধূমকেতু” হবে আগুনের সম্মার্জনা।’ (আমার পথ)।
ঝাঁটাই হোক, কি ঝান্ডাই হোক, যে অগ্নিপ্রতীক এ দুটো শব্দ ধারণ করেছে সেটি মঙ্গল কর্মের শুচি বার্তা বহন করে এনেছে দেশের স্বাধীনতার পথে। ওই চেতনা দিয়েই নজরুলের কাব্যযাত্রার সূচনা। সেখানে ওই ঝান্ডাই তাঁর দিশারি, তাঁর শক্তি, তাঁর শপথ। জয়োল্লাসে উজ্জীবিত দেশের অগ্রপথিক মুক্তিসেনানিদের হাতেও, অগ্নিপুচ্ছ ধূমকেতুর মতোই, সেই ঝান্ডা—
বজ্র-শিখার মশাল জ্বেলে আসছে ভয়ঙ্কর। (প্রলয়োল্লাস)
নজরুল কাব্যের প্রথমাংশে আগুনের পুনরাবৃত্তি বেশ লক্ষ করবার মতো।— কতভাবে কতরূপে সেই আগুনের ব্যঞ্জনা। প্রচণ্ডতা, ভয়ংকরতা, তীব্রতা, ধ্বংস, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং অবশ্যই বিদ্রোহ, সহজেই আগুনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। ‘বিদ্রোহী’র আত্ম-উদ্বোধনও ওই অগ্নি পরিচয় পুষ্ট।
১. আমি হোম শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
২. আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ববহ্নি, কালানল;
আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-জল-কোলাহল।
ধূমকেতু আর আগুন সমার্থকতা বহন করে নজরুলের কবিতায়। ‘ধূমকেতু’ নামের বিখ্যাত কবিতাটিতে স্বভাবতই আগুনের প্রসঙ্গ ঘুরেফিরে বারবার আসে; বলা যায় সমগ্র কবিতাটি আগুন দিয়েই মোড়া। কবি ধূমকেতুরূপ অগ্নিকেতন উড়িয়েছেন তা নিশ্চয়ই পরদেশি শাসকের বুকে ত্রাস সৃষ্টির জন্য। সেই ধূমকেতু তো কবি নিজেই, ‘বিদ্রোহী’র মতোই, ‘আমি’ ‘আমি’ দিয়ে সোচ্চার বীর্যবান অগ্নিপুরুষ।—
১. সাত—সাতশ নরক-জ্বালা জ্বলে মম-ললাটে।
মম—ধূম-কুণ্ডলী করেছে শিবের ত্রিনয়ন ঘন ঘোলাটে।
২. আমি শি শি শি প্রলয় শিস দিয়ে ঘুরি কৃতঘ্নী ঐ বিশ্বমাতার শোকাগ্নি,
আমি ত্রিভুবন তার পোড়ায়ে মারিয়া আমিই করিব মুখাগ্নি।
৩. পঞ্জর মম খর্পরে জ্বলে নিদারুণ সেই বৈশ্বানর,
শোনরে মর, শোন অমর।—
সে যে তোদের ঐ বিশ্বপিতার চিতা।
এ চিতাগ্ন্নিতে জগদীশ্বর পুড়ে ছাই হবে, হে সৃষ্টি জান কি তা?
হো হো ভগবানে আমি পোড়াব বলিয়া জ্বালিয়াছি বুকে চিতা।
৪. ঘিরিয়া ঘিরিয়া খেলিতেছি খেলা, হাসি পিশাচের হাসি
এই অগ্নি-বাগিনী আমি যে সর্বনাশী।
বিষের বাঁশীও ভরপুর অগ্নিবিষে। সে বিষ উগরে দিতে হয় অন্যায়-অবিচারের হোতা ভিনদেশি শাসককে, সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। সে উন্মাদনা প্রকাশ পায় প্রলয়-নৃত্যের ছন্দে—
জ্বলে বৈশ্বানরের ধূ ধূ লক্ষ শিখা,
আজ বিষ্ণু-ভানে জ্বলে রক্ত-টীকা।
শুধু অগ্নি-শিখা ধূ ধূ অগ্নি-শিখা
শোভে করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা। (জাগৃহি)
পৌরাণিক প্রসঙ্গে আগুন যে ভয়াবহতার আবহ সৃষ্টি করে দেশ মুক্তির প্রশ্নে, নজরুল সেগুলোর সবটারই কাব্যিক প্রকাশ ঘটান। ওদিকে ভাঙ্গার গানেও অগ্নিবীণা বাজে। অধীনতার কারাগারকে লাথি মেরে ভেঙে ফেলার জোর ঘোষণায় কবিতাটি শেষ হয় বটে, কিন্তু আমাদের চেতনায় তা চির অগ্নি-উন্মাদনা জাগিয়ে দেয়—
লাথি মার, ভাঙরে তালা।
যত সব বন্দী-শালায়—
আগুন জ্বালা,
আগুন জ্বালা, ফেল উপাড়ি।
সমকালে নজরুল তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় যেসব সম্পাদকীয়-নিবন্ধ লিখেছেন সেগুলো তাঁর কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে পড়া যায়। স্বদেশানুভূতি, চিন্তা, ভাবনা, কর্তব্যকর্ম, মুক্তির শপথ, উজ্জীবন, জাগরণ সবই তো অগ্নিবীণার সুর। ধূমকেতুতে প্রকাশিত ছোট নিবন্ধগুলোই বেশি আবেগী, বেশি উদ্দীপক, বেশি অগ্নিদীপ্ত ও জ্বালাময়। কবি কোথাও অগ্নি-নাগদের বিবর থেকে বেরিয়ে আসার ডাক দেন, কখনো প্রেরণাদীপ্ত করেন যূথ শক্তিমন্ত্রে। এরাই মুক্তিসংগ্রামের তরুণ দল, এরাই স্বাধীন দেশের অগ্নিসৈনিক।
১. বেরিয়ে এস, বেরিয়ে এস বিবর থেকে অগ্নি-বরণ নাগ-নাগিনী, তোমার নিযুত ফণা দুলিয়ে। (তুবিড় বাঁশির ডাক)।
২. পাতালপুরের নিদ্রিত অগ্নি-সিন্ধুতে ফুঁ দাও, ফুঁ দাও—ফুঁ দিয়ে জ্বালাও তাকে। আসুক নিখিল অগ্নিগিরির বিশ্ব-ধ্বংসী অগ্নিস্রাব, ভস্মস্তূপে পরিণত হোক এ-অরাজক বিশ্ব। (ঐ)
৩. ওরে আমার ভারতের সেরা, আগুন খেলার সোনার বাঙ্লা। কোথায় কোন্ অগ্নিগিরির তলে তোর বুকের অগ্নি-সিন্ধু নিস্তব্ধ নিস্পন্দ হয়ে পড়ল? কোথায় ভীমের জন্মদাতা পবন? ফুঁ দাও, ফুঁ দাও এই নিবন্ত অগ্নি-সিন্ধুতে, আবার এর তরঙ্গে তরঙ্গে নিযুত নাগ-নাগিনীর নাগ-হিন্দোলা উলসিয়া উঠুক। (আমি সৈনিক)।
৪. এ কি বেদনা! এ কি ক্রন্দন! উৎপীড়িতের আর্তনাদে ‘মজলুমের ফরিয়াদে’ আকাশের সারা গায়ে আজ জ্বালা, বাতাসের নিঃশ্বাসে ব্যথা, মাতা বসুমতীর বুক ফেটে নির্গত হচ্ছে অগ্নিস্রাব আর ভস্মধূম। (রুদ্রমঙ্গল)
নজরুল আগুনকে নিয়েছিলেন বীর্যশক্তির প্রতীক হিসেবে; তবে এর চেয়েও অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের প্রতীকতায়। আগুনের ধ্বংসকারী ক্ষমতা অপরিসীম, সম্ভবত পঞ্চভূতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। নজরুলের সাহিত্যে এর ব্যবহারও অপূর্ব ব্যঞ্জনাময়। উপনিবেশের কালে এ প্রতীকের সাহিত্যিক-সামাজিক তাৎপর্য সহজেই অনুধাবনযোগ্য। নজরুল যে চেতনার মানুষ তাতে আগুন তাঁর বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের যথাযথ ভাষা হয়ে ওঠে। উপমা, তুলনা দৃষ্টান্ত ও রূপকল্পগুলো খুবই আবেগী, অনেক সময় সেগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত না হলেও কবির আন্তরিক অনুভূতির প্রকাশ সেগুলো। নজরুল যখন সাহিত্য জীবনে প্রবেশ করেন তখন পরাধীন দেশের সচেতন মানুষ নিয়মতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিক নানা আন্দোলন ও কর্মসূচি নিয়ে ব্যাপৃত। প্রথম মহাযুদ্ধের পর থেকে কলোনিগুলোতে শুরু হলো ভাঙনের পালা। বিভিন্ন দেশে তখন স্বাধীনতাকামী মানুষের জাগরণ! কেবল রাজনৈতিক মুক্তি নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিও এ জাগরণের লক্ষ্য। এর ঢেউ এসে লাগল নজরুলের দেশে। প্রবল স্বাধীনতাকামী আবেগ-উদ্দীপ্ত নজরুল যে পটভূমি ও প্রেরণায় কবিতা লিখলেন এবং জ্বালাময়ী গদ্য নিবন্ধ, রচনা লিখলেন তাতে অগ্নিই হয়ে উঠল তাঁর মুক্তিমন্ত্র, দেশের জন্য গণমানুষের জন্য। সুতরাং কবি-কর্মী বিদ্রোহী নজরুল যে অগ্নিবীণা বাজাবেন এবং নিজেও কালের অগ্নিবীণা হবেন, তা তো স্বাভাবিকই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০
Leave a Reply