চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার ফতেয়াবাদ গ্রামের আলম পরিবারের বাসগৃহে কবি নজরুল বেড়াতে আসেন ২৫ জানুয়ারি ১৯২৯ সাল। তিনি এক রাত ছিলেন। ২৬ তারিখ আলম পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া একটি সংবর্ধনা গ্রহণ করে তিনি ফিরে যান শহরে। আবুল ফজল অবশ্য তাঁর আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিগ্রন্থ রেখাচিত্রে বলছেন, কবি ফতেয়াবাদে বেশ কয়েক দিন ছিলেন।
নজরুলের ফতেয়াবাদে আসার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন দিদারুল আলম (১৯০৩/৫-১৯২৯)। এ প্রসঙ্গে আবুল ফজল লিখছেন: ‘দিদারুল আলম কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে মাসিক যুগের আলো ও সাপ্তাহিক সম্মিলনী সম্পাদনা করে বাংলা ও ব্রহ্মদেশে যথেষ্ট খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছিল। মাসিক ও সাপ্তাহিক সওগাতে তাঁর বহু লেখাই ছাপা হয়েছে। সেসব লেখায় তাঁর শক্তি ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে স্বয়ং নজরুল ইসলামও মুগ্ধ হয়েছিলেন। দিদারুলের আমন্ত্রণে নজরুল একবার তাঁদের বাড়ি গিয়ে কয়েক দিন কাটিয়েও ছিলেন।’ (রেখাচিত্র)
ফতেয়াবাদের মৌলবি নসিহউদ্দিনের ছিল চার ছেলে। বড় ছেলে শামসুল আলম (১৮৯৬—১৯৩৮) তীক্ষ প্রতিভাধর ছিলেন, কিন্তু রেঙ্গুনে বাঙালি-বর্মি দাঙায় নিহত হন ১৯৩৮ সালে। তিনি আলম পরিবারে আধুনিক চিন্তা ও সাহিত্যমনস্কতার প্রবেশ ঘটান। এর পরের জন মাহবুব-উল আলম (১৮৯৮—১৯৮১) একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক, যাঁর সঙ্গে নজরুলের সময়গত মিল হলো যে দুজনেই ৪৯ বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু বেমিল হলো এখানে যে মাহবুব পুরো তিনটি বছর (১৯১৭—১৯২০) মেসোপটেমিয়ার (বর্তমান ইরাক) বসরা এবং কুতল আমারাতে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটালেও, নজরুলকে করাচির ডিপোর বাইরে যেতে হয়নি। নজরুল করাচিতে বসেই কোয়ার্টার মাস্টার হিসেবে ল্যান্স নায়ক থেকে হাবিলদার পদমর্যাদায় উন্নীত হন। কিন্তু তত দিনে তাঁর কাব্য ও গীতি-প্রতিভার খবর কলকাতা হয়ে সারা বাংলায় যেমন ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি যুদ্ধক্ষেত্রে বাঙালি সৈনিকদের কাছেও পৌঁছায়। মাহবুব যুদ্ধরত অবস্থায় তাঁর সতীর্থ মনোরঞ্জন দাসের কাছে প্রথম শোনেন যে হাবিলদার কাজী নামের একজন কবি ও গায়ক ‘আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে’ গান গাইছেন, ‘সামনে হারমোনিয়াম, চলছে গানের পর গান, খাচ্ছেন কাপের পর কাপ চা, খিলির পর খিলি পান।’ কিন্তু শারীরিকভাবে না হলেও নজরুল মানসচক্ষে ঘুরে বেড়িয়েছেন ‘শাতিল আরবের যুদ্ধক্ষেত্র, তুর্কির রণক্ষেত্রে আনওয়ার পাশা ও কামাল পাশার সাথে এবং ভার্দুন টেঞ্চে মিত্র বাহিনীর সাথে।’ (মাহবুব-উল আলম: ‘নজরুল প্রেক্ষা’, রঙ বেরঙ।)
যুদ্ধশেষে মাহবুব যখন করাচি ডিপো হয়ে দেশে ফেরত আসছেন, তার আগেই নজরুল করাচি ত্যাগ করেছেন এবং কলকাতায় ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে জাঁকিয়ে বসেছেন। সে জন্য কবি নজরুল ও মাহবুবের মধ্যে পল্টন-জীবনে চাক্ষুষ পরিচয়ের সুযোগ হয়নি।
কিন্তু মাহবুবের সাত বছরের ছোট ভাই দিদারুল আলম তখন কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে খুব নাম করছেন। মেজাজে ছিলেন চূড়ান্ত বিদ্রোহী। চট্টগ্রাম সরকারি মাদ্রাসায় পড়ার সময় আবুল ফজল হয়ে ওঠেন তাঁর অচ্ছেদ্যপ্রাণ অভিন্নহূদয় বন্ধু। গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে দুজনেই পড়াশোনার পাট চুকোনোর কথা বলে স্কুল ছাড়লেও আবুল ফজল ফিরে আসেন পিতার পিটুনি খেয়ে ‘গোলামখানায়’, কিন্তু দিদার আর ফিরলেন না। (রেখাচিত্র)
অষ্টম শ্রেণীর চূড়ান্ত পরীক্ষায় দিদার প্রথম স্থান অধিকার করলেও তাঁর শ্রদ্ধাভাজন প্রধান শিক্ষক শমসুল ওলামা কমালুদ্দিন আহমদ সাহেবের অনুরোধও স্কুলে ফেরার ব্যাপারে তাঁর মন গলাতে পারেনি। সেটা ১৯২১ সাল। ভাইয়ের মন স্থিত করতে মাহবুব দিদারকে যুগের আলো নামের একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করে সম্পাদক করে দিলেন। ১৯২৩। পত্রিকাটি প্রথমে ত্রৈমাসিক ছিল। হাজারী লেইনের হার্ডিঞ্জ প্রেস থেকে সেটি ছাপা হতো। লিখতেন বঙ্গচন্দ্রনাথ কাব্যবিনোদ, সৈয়দা মোতাহেরা বানু, এম ফাতেমা খানম, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ উদ্দীন, আবদুল কাদির, আবদুল হক ফরিদী, মাহবুব-উল আলম, জসীমউদ্দীন প্রমুখ। পত্রিকাটি মাসিকে রূপান্তরিত হয়। (ওহীদুল আলম, পৃথিবীর পথিক)
দিদার এর মধ্যে গিয়ে উঠলেন কলকাতায় নজরুল পরিবেশে। মাহবুব লিখছেন, নজরুল তাঁর প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল হয়ে ওঠেন এবং ওই পরিবেশে আবদুল কাদির, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন, তাঁর স্ত্রী রহিমা বেগম এবং অপরাপরের সঙ্গে তিনি গভীর অন্তরঙ্গভাবে পরিচিত হন। দিদার মাকে গিয়ে বললেন, ‘মা, মোজাফফর আহমেদ (কমরেড) নামে আমার এক বন্ধু আছে, একদিন হয়তো তাঁর মতো পিঠে ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে যাব।’ নজরুল তখন গানের আসরে ডা. মিসেস এস বি মুখার্জির ফরমায়েশে গাইছেন: ‘করুণ কেন অরুণ আঁখি দাও গো সাকি দাও শারাব’। অথচ এদিকে দিদার ক্রমেই শুকিয়ে যাচ্ছেন। আমার দাদি খুব চিন্তিত, কোনোভাবে ছেলেকে বিয়েতে রাজি করাতে পারছেন না। দিদারকে আসলে তখন ক্ষয়রোগে ধরেছে। এ যাবৎ আলম পরিবারের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি এখানে যে তাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র অকালে প্রাণ হারান।
১৯২৮ সালের শেষভাগে হবীবুল্লাহ বাহার ও দিদারের টানে নজরুল চট্টগ্রাম আসেন। বাহারের নানা ছিলেন বিশিষ্ট নাগরিক আবদুল আজিজ বিএ এবং তাঁর তামকু মুন্ডিস্থ (বর্তমান রেওয়াজুদ্দিন বাজারের একটি অংশ) বাসভবনে নজরুল ওঠেন। একদিন সকালে একটি বিশেষ ট্যাক্সি এনে দিদার ও ফজল নজরুলকে বলেন, ‘চলেন, একটু গ্রামের দিকে ঘুরে আসি।’ নজরুল তো সতত উড্ডয়মান। নজরুলকে মাঝখানে বসিয়ে দিদার ও আবুল ফজল দুপাশে বসে ফতেয়াবাদের আলম পরিবারের বাসগৃহে পৌঁছালেন।
তখন ফতেয়াবাদ গ্রামের বৈশিষ্ট্য ছিল সুপারি গাছ। এ রকম ঘন সুপারি বন সাধারণত দেখা যায় না। এমনকি ষাটের দশকে আমরা যখন বাড়িতে যেতাম, সুপারি বনের ভেতর লুকোচুরি খেলতে খেলতে হারিয়ে যাওয়া ছিল আমাদের প্রধান খেলা। আমাদের বাড়িটা ছিল আর দশটা বাড়ির মতো, একটা প্রধান বাটি, মাঝখানে উঠোন, বাড়ি-সংলগ্ন পুকুর, আর সামনে ছোট বাংলো টাইপের দেউড়ি ঘর। এ দেউড়ি ঘরটা ছিল সুপারি বনের ভেতরে।
যেদিন নজরুল আলম বাসগৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেন, সেদিন দুর্ভাগ্যবশত আলমদের সবচেয়ে ছোট ভাই কবি ওহীদুল আলম (১৯১১—১৯৯৮) বাড়িতে উপস্থিত ছিলেন না। কেননা এর আগে ১৯২৮ সালের জুন মাসে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁদের বাবা মৌলবি নসিহউদ্দিন মৃত্যুমুখে পতিত হলে ওহীদ নিতান্ত ভেঙে পড়েন এবং হতাশা থেকে রেঙ্গুন পালিয়ে যান।
বাবার মৃত্যুর কারণে মাহবুব বাঁশখালীর কার্যক্ষেত্র থেকে এসে বাড়িতে বাস করছিলেন। বাড়ির পুকুর থেকে মাছ ধরে রান্নার আয়োজন হয়। দুপুরে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে খেতে বসলেন মাহবুব, দিদার, ফজল ও নজরুল। ভাত বেড়ে দিচ্ছিলেন আমার দাদির মা। নজরুল খুব রসিকতা করতে পছন্দ করতেন। দাদির মা ৮০ বছরের বুড়ি হলেও খুব সুন্দরী ছিলেন, আর নজরুলের গজলের ভক্ত ছিলেন। নজরুল বললেন, নানি, আমরা কিন্তু পঞ্চপাণ্ডব খেতে বসেছি। এ বলে তিনি বাড়ির বিড়ালটার দিকে ইঙ্গিত করলেন, যে এতক্ষণ ম্যাও ম্যাও করে মাছের কাঁটা যাচনা করছিল। তখন ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি ছিল স্যার গ্রিনউড হ্যামার। নজরুল বললেন, ‘কাঁচা কাঠের হাতুড়ি মশাই’। সওগাতের সম্পাদক নাসিরউদ্দিনের কথা উঠলে নজরুল বললেন, ‘কবন্ধ উড্ডীন’। (মাহবুব-উল আলম ‘দেখার নজরুল’, রঙ বেরঙ)
রাত্রে কবির শোয়ার ব্যবস্থা হলো সে দেউড়ি ঘরেই। ছোট বাঁশের ঘর। সঙ্গে মাহবুব, দিদার ও ফজল। সেদিন অপূর্ব জ্যোৎস্না উঠেছিল। মাহবুব লিখছেন—‘জ্যোৎস্না রাতে সুপারি বাগানে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিটি সুপারি গাছে লেপ্টে থাকে রূপার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সাপ—সুপারি গাছ যখন ধীরে ধীরে মাথা দোলায় এই প্রকাণ্ড সাপগুলো যেন সজীব হয়ে খেলা করতে থাকে।
‘রাত্রে খিড়কি খুলে নজরুল এই খেলা দেখতে পান এবং একেবারে তন্ময় হয়ে যান। অস্ফুটে শুধু উচ্চারণ করতে থাকেন “আ-হা-হা, কী দেখলাম!” “আ-হা-হা, কী দেখলাম!” (প্রাগুক্ত)
মাহবুব এবং ওহীদের ধারণা কবি তাঁর বিখ্যাত ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতাটি লেখার প্রেরণা এখান থেকেই পান।
আলম পরিবারের পক্ষ থেকে কবিকে ২৬ জানুয়ারি যে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তা রচনা করেন দিদার নিজেই, এবং সেটির অনুচ্ছেদগুলোর শুরুর সম্বোধনগুলো ছিল নিম্নরূপ: কবি নজরুল ইসলাম / করকমলেষু। প্রথম অনুচ্ছেদ: ‘হে সৈনিক কবি’, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ, ‘হে ব্যথার কবি’, তৃতীয় অনুচ্ছেদ, ‘হে সর্বহারার কবি’, চতুর্থ অনুচ্ছেদ, ‘হে প্রেমিক কবি’, এবং শেষ অনুচ্ছেদ, ‘হে প্রাণের কবি’। সমাপনে ছিল: ‘ফতেয়াবাদ / ২৬শে জানুয়ারী, ১৯২৯ ইং / ইতি তোমারই আলম পরিবার।’
কিন্তু কবিভক্ত ও বন্ধু কবি দিদারুল আলম যক্ষ্মা রোগে ভুগে ১৯২৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রাণত্যাগ করেন। পরের বছর কবি আবদুল কাদিরের একক প্রচেষ্টায় ঢাকা থেকে মাসিক সঞ্চয় দিদারুল আলম বিশেষ সংখ্যা বের করেন, যাতে আবুল ফজল লিখছেন, ‘তরুণ-প্রবীণ অনেক সাহিত্যিকের লেখা ওই সংখ্যাটির গুরুত্ব ও সমৃদ্ধি বাড়িয়েছিল। এর আগে ও পরে আমাদের অনেক তরুণ ও প্রবীণ সাহিত্যিকের মৃত্যু ঘটেছে কিন্তু তখন পর্যন্ত আর কারও সম্বন্ধে কোনো পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা বের হয় নি।’ (রেখাচিত্র)
নজরুল ১৯৩৩ সালে রাউজানে অনুষ্ঠিত এক সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে এলে ফতেয়াবাদের বড় রাস্তার পাশে মসজিদসংলগ্ন স্থানে, যেখানে দিদারকে চিরসমাহিত করা হয়, সেখানে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে তাঁর কবর জিয়ারত করেন।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের আলম পরিবারের বাসগৃহে আতিথ্য গ্রহণের স্মৃতি রক্ষার্থে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪০৭ সালে বাড়ির মূল ফটকের সামনে একটি স্মৃতিফলক তৈরি করে দেন। শিরোনামে লেখা আছে, ‘নজরুল স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম’। আর গাত্রে লেখা আছে, ‘কবির সাথে আলম ভ্রাতৃত্রয়ের ছিল আত্মিক সম্পর্ক’।
ভ্রাতৃত্রয়, কেননা সর্বজ্যেষ্ঠ ভাই শামসুল আলমের (১৮৯৬—১৯৩৮) কথা জেলা প্রশাসনের প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিফলকে আসেনি, তাঁর সঙ্গে নজরুলের কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না বলে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০
Leave a Reply