কাজী নজরুল ইসলাম আমরা সবাই জানি, নজরুল-সাহিত্যে নারীর নানামাত্রিক প্রকাশ রয়েছে। নারী কবির প্রেমিকা, বধূ, মাতা ইত্যাদি। কিন্তু সমগ্র নজরুল-সাহিত্য বাদ থাকুক, শুধু কবিতায় নজরুল শত-সহস্রবার ‘মা’কে ডেকেছেন। সমগ্র বাংলা কবিতার ইতিহাসে তাঁর চেয়ে অধিক আর কেউ ‘মা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বলে অন্তত আমার জানা নেই। সেই মায়েরও আবার নানা রূপ—আশ্রয়দাত্রী, সৃজনসম্ভবা কিংবা ধরিত্রী। মায়ের বিচিত্র স্বরূপ-উদ্ভাসনে নজরুল আশ্রয় নেন ভারতীয় পুরাণের। জন্মসূত্রে মুসলমান হলেও এ ক্ষেত্রে আরব্য পুরাণ তাঁর সহায় হয় না। কেননা, আরব্য বা আক্কাদ পুরাণে ধরিত্রী নেই, মাতৃভূমি নেই, আছে পিতৃভূমি।
ভারতীয় সভ্যতা মাতৃকেন্দ্রিক। প্রাগার্যকালে মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা তথা সিন্ধুসংস্কৃতিতে নারী-আরাধনার প্রভূত রূপকল্প বিদ্যমান ছিল বলে নৃ-বিজ্ঞানীদের ধারণা। সিন্ধুসংস্কৃতির জলিলপুর, সুমলা, সরাইখোলা অর্থাৎ কোট-দিজিয়ান অঞ্চলে প্রাপ্ত নারীমূর্তির বিশেষায়িত উপস্থাপনা তারই স্মারক। এখানে নারীর সূত্রে এসে যাবে পুরুষ দেবতার অনুষঙ্গ—তিনি শিব। শিবও প্রাগার্য দেবতা। প্রাকৃতিক-ভৌগোলিক কারণে মরুময় ঊষর আরবদের লাঙল ছিল না কিন্তু সিন্ধুবাসীদের ছিল। আর লাঙল ও মৃত্তিকার সূত্রধর ছিলেন শিব—মাটিতে ফসল বোনার মুহূর্তেই নেওয়া হতো শিবের শরণ। আজও উর্বরতা বা সৃজনক্ষমতার প্রতীক শিবের পুজো হয় বিশেষত সন্তানকামনায়। শিব এবং নারীর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য—বৈশাখ মাসে কুমারীদের শিবপূজা সুপ্রাচীন অভ্যাসের ধারক। শিবও নজরুলের সৃজনে-মানসে প্রবলভাবে উপস্থিত। আজ থেকে প্রায় তিন দশককাল আগে রচিত একটি প্রবন্ধে (‘নজরুলের নটরাজ: বিশ্বছন্দের প্রত্নপ্রতিমা’) সমালোচক সৈয়দ আকরম হোসেন নজরুল মানসের এই বিশেষ দিকটিকে চিহ্নিত করেছিলেন—
‘শিব নজরুলের সুপ্তিমগ্ন চেতন-অবচেতনায় ও শিল্পসূত্রযোজনায় বিচিত্র—যেমন: রুদ্র, ভৈরব, দিগম্বর, ধূর্জটি, ব্যোমকেশ, পিনাকী, ত্রিশূলী, শিব, মহেশ, শঙ্কর, নটরাজ প্রভৃতি।’
শিব প্রাগার্য যুগে ছিলেন সৃষ্টিরই দেবতা, কেননা সৃষ্টির যাবতীয় অনুষঙ্গে তাঁর বর্তমানতা। সিন্ধুসভ্যতা সম্পূর্ণরূপে অশ্ববিহীন এবং ষাঁড়াশ্রিত। আবিষ্কৃত বিভিন্ন ষাঁড়-সিলমোহরে কৃষিজীবী সিন্ধুবাসীদের সেই পশুকেন্দ্রিকতা আজও শিবকে স্মরণ করায় তাঁর ষাঁড়-বাহনের প্রতিপাদ্যে। আর্যরা শিববিরোধী ছিল। আর্যরচিত গ্রন্থে শিবকে এবং শিবের অনুসারী ‘বিশ’ বা প্রজাদের ভর্ৎসনা করা হয়েছে তীব্র ভাষায়। আর্যরা তাদের দেবতা ব্রহ্ম এবং ইন্দ্রকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল প্রবলভাবে। ভারতবর্ষীয় প্রকৃত সৃষ্টির দেবতা শিব হয়ে গেলেন কালক্রমে প্রলয়ের দেবতা, হয়ে গেলেন অপ্রকৃতিস্থ, সিদ্ধিখোর। প্রাগার্য যুগে একজন নেশা-ভাং খাওয়া দেবতার পক্ষে কোনোভাবেই মহাসৃষ্টির মতো এমন বিশাল বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া সম্ভবপর ছিল না।
সমগ্র উত্তর ভারত তথা আর্যাবর্ত আর্যপ্রভাবের কারণে পূর্বেকার দেবীমূর্তিগুলো হারিয়ে ফেলে কিন্তু আর্যবিরল পূর্ব দিকে সেসব দেবী বা মাতৃমূর্তিসমূহ সহজে অপসৃত হলো না—আর তাদের কেন্দ্রভাগে থাকেন দশ-শক্তির উৎস মহিষাসুর। উত্তর ভারতেও হাজার হাজার বছরের প্রাচীন দেবতা শিব এবং শিবানীকে (কালী) জনমানস থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না আর্যদের পক্ষে। সেই প্রাচীন শিব এবং সেই প্রাচীন ‘মা’কে নানা রূপে-ভাবে-প্রতীকে উপস্থিত হতে দেখা যায় নজরুলের কবিতায়। তাঁরা মূলত সৃষ্টির, আবার প্রলয়েরও। সৃষ্টি-প্রলয়ের নজরুলীয় শিব-শিবানী ভারতীয় প্রত্ন-মানস থেকে উদ্ধৃত হয়ে গ্রথিত হন সমকালীন মানসে—যুগের প্রয়োজনে।
নজরুল প্রবলভাবে মায়ের অনুসারী—আবার চণ্ডী, অন্নদা—
‘মা গো, আজো বেঁচে আছি তোরি প্রসাদ পেয়ে।
তোর দয়ায় মা অন্নপূর্ণা তোরই অন্ন খেয়ে।’
(‘শ্যামা’, রাঙা-জবা)
কিশোর-কাব্য ঝিঙেফুল—এও মা আসবেন—‘মা’র বড় কেউ নাই/ কেউ নাই কেউ নাই।’ (‘মা’) শত সহস্রবার ব্যবহার করা এই শব্দটিকে নজরুল এক অপরূপ প্রেরণার আধারে পরিণত করেন। ‘মা’ যে শুধু এক স্নিগ্ধ-শ্যামল-শান্ত মুখশ্রীসম্পন্না নারী হয়ে আসেন তা নয়, তিনি এক বিপুল শক্তির উৎসও বটে। সমকালীন উপনিবেশ-বিরোধিতার সংগ্রামে মায়ের শক্তিকে প্রচণ্ডভাবে আঁকড়ে ধরেন কবি—
‘আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশহাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসূর।’
(‘আগমনী’, অগ্নি-বীণা)
এবং এক প্রচণ্ডতার দৃশ্যকল্পে কেবল পুরান নয়, বস্তুত কেঁপে ওঠে সমকাল—
‘নিদ্রিত শিবে লাথি মার আজ,
ভাঙো মা ভোলার ভাঙ-নেশা।’
(‘রক্তাম্বরধারিণী মা’, অগ্নি-বীণা)
নজরুলের কবিতা-কাব্য যে এতবার নিষিদ্বঘোষিত হয় তার পেছনে হয়তো দায়ী তীব্র প্রত্যক্ষ-ভাষণ কিন্তু উপর্যুক্ত পৌরাণিক দৃশ্যকল্পটির বর্তমান-সংলগ্নতা নিশ্চয়ই অক্ষরজ্ঞানহীন লোকের শ্রুতিকেও নাড়াতে সক্ষম। ‘নিদ্রিত শিব’ এবং উৎক্ষিপ্ত মাকে বোঝা কারও পক্ষেই দুঃসাধ্য নয়। নজরুল এমনই মা-অন্তপ্রাণ যে ধ্রুব ছায়াছবির গানেও এসে পড়েন সেই মা। সেখানে তাঁর ‘মা’ চিরদুঃখী, মলিন। এ-পুরাণও যে স্বদেশ-সমকালচেতন তা ধ্রুব ছবির দর্শকমাত্রেরই অনুভব করার কথা। দরদভরা কণ্ঠে কবির প্রতিশ্রুতি—
‘কাঁদিস নে আর কাঁদিস নে মা,
আমি মা তোর দুখ ঘুচাব।
বসন-ভূষণ দেবো এনে
মা তোর চোখের জল মুছাব।’
নজরুলের জীবন্মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘রাঙা-জবা’, ‘দেবীস্তুতি’ ‘হরপ্রিয়া’ ও ‘দশমহাবিদ্যা’র মাতৃ-রূপকাশ্রিত কবিতা ও গানে পুরাণ এবং সমকাল একে অন্যের পরিপূরণকারী।
কবি নজরুলের মায়ের শরণ কাজেই শক্তির শরণ। সে কঠিন অভিযাত্রায় শক্তির সঞ্চারক শিব। প্রবল আর্য-প্রভাব ও আর্য-প্রসারণের পরও যেমন প্রাগার্য যুগের শিব-দুর্গাকে হঠানো সম্ভব হয় না, তাঁরা প্রবলভাবেই বিরাজমান থাকেন ভারতবর্ষীয় মানসে, ঠিক তেমনি ভারতবর্ষের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এক সংগ্রামী যোদ্ধা আক্রমণের হাতিয়ার অনুসন্ধান করেন সাত-আট হাজার বছর আগেকার যূথবদ্ধতার মধ্যে এবং সেই হাতিয়ার ছুঁড়ে দেন সমকালের শত্রুকে লক্ষ্য করে। উভয়ের দূরত্ব অকল্পনীয় হলেও শেকড়ের শক্তিকে চিনতে ভুল হয় না যোদ্ধা কবির।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০
Leave a Reply