একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময়—
আনোয়ার উল আলম শহীদফেব্রুয়ারি ২০০৯সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকাপ্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার৪০৭ পৃষ্ঠা ।। ৪০০ টাকা
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালির ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর সমসাময়িক ইতিহাসেও বড় একটি ঘটনা। ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি নিয়ে অনেকেই লিখেছেন এবং বলেছেন। স্মৃতিচারণামূলক বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে নতুন আরও একটি বই—আনোয়ার উল আলম শহীদের একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময়।
লেখক আনোয়ার উল আলম শহীদ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষদর্শী, সাক্ষী ও সক্রিয় যোদ্ধা। এর আগে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন আমাদের জাতীয় ও ছাত্র রাজনীতিতে উত্তাল অবস্থা। সেই সময় পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ছাত্র-তরুণদের প্রতিবাদী চেতনা কর্মের সক্রিয় সঙ্গী ছিলেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব যখন শেষ, তখনই শুরু হয় আমাদের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।
আনোয়ার উল আলম শহীদ একাত্তরে টাঙ্গাইলের প্রতিরোধে এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। পাশাপাশি সাংগঠনিক বহুমাত্রিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও তিনি পালন করেন। তিনি তাঁর সেই ঘটনাবলি প্রত্যক্ষদর্শীর জবানিতে একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় বইয়ে তুলে ধরেছেন। নামটি দেখে যে কারোরই মনে হওয়া স্বাভাবিক এই বইটি শুধু একাত্তর ঘিরেই। কিন্তু তা নয়, বইটি এক অর্থে তাঁর আত্নজীবনী, যা ১৯৭২ সালে শেষ হয়েছে। এর বিরাট অংশ নিয়ে আছে তার দেখা একাত্তর ও সংশ্লিষ্ট পূর্বাপর ঘটনা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছিল। টাঙ্গাইল ছিল নয় নম্বর সেক্টরের অধীন। কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত মুক্তিবাহিনী ওইসব সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত থেকে দেশের সর্বত্র যুদ্ধ করে। এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল ছাত্র-যুবক, বাঙালি পুলিশ, ইপিআর ও সেনাসদস্য সমন্বয়ে। এর বাইরে দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইল, বরিশাল, ফরিদপুরে আলাদাভাবে কয়েকটি বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এমন একটি বাহিনীর নাম ছিল কাদেরিয়া বাহিনী। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ওই সব বাহিনীর মধ্যে এই বাহিনীই ছিল সবচেয়ে বড়। সীমিত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা সাহসিকতার সঙ্গে টাঙ্গাইলে পাকিস্তান বাহিনীকে মোকাবিলা করে। এত দিন আমাদের জানা ছিল বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীই এই বাহিনী গঠন করেন এবং তিনিই ছিলেন এর মূল ভূমিকায়।
একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় বই পড়ে এখন জানা গেল আনোয়ার উল আলম শহীদও ছিলেন এই বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। মূলত তাঁরা দুজনই আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এই বাহিনী গড়ে তোলেন। কাদের সিদ্দিকী মূলত যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। অন্যদিকে আনোয়ার উল আলম শহীদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। ফলে তাঁকে বহুমাত্রিক কাজ করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামঝি কিছু দিনের জন্য তিনি এই বাহিনীর সামরিক নেতৃত্বও দেন। তাঁর ভাষায়, ‘…কাদের সিদ্দিকী যুদ্ধ পরিচালনায় সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দেয়। সেনাবাহিনীর কর্মরত ও প্রাক্তন সেনাদের মধ্যে যারা আমাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তাদের মধ্যে কাদের সবচেয়ে বেশি যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রদর্শন করে। তার নেতৃত্ব-ক্ষমতা ও সাংগঠনিক শক্তি টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর সাফল্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে কাদেরের অনুপস্থিতিতে আমাকে সামরিক প্রধানের দায়িত্বও পালন করতে হয়।’ পৃষ্ঠা ২৫৪।
১৯৭১ সালে কাদেরিয়া বাহিনী পাকিস্তানিদের কাছে ত্রাস হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বাহিনী টাঙ্গাইলের কিছু এলাকা মুক্ত রেখে সেখানে অবস্থান করেই যুদ্ধ করেছে। এবং তাদের তৎপরতার কারণেই ডিসেম্বরের শুরুতে টাঙ্গাইলের বিরাট এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। এর ফলে মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা টাঙ্গাইলে সমবেত হয়ে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছে যায়।
কাদেরিয়া বাহিনী ও এর নেতা হিসেবে আবদুল কাদের সিদ্দিকীর নাম আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু আনোয়ার উল আলম শহীদের নাম বেশির ভাগেরই অজানা। কাদেরিয়া বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে কাদের সিদ্দিকী নিজেও বই লিখেছেন। কিন্তু একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় বইটি তার থেকে বেশ তফাৎ। কারণ সেই সময়ের অনেক ঘটনা ও তথ্য এই বইটি পড়েই আমরা প্রথম জানতে পারি। এই বইটি সংকীর্ণতা ও একদেশদর্শীতা থেকে কিছুটা মুক্ত। তবে নিজস্ব ভূমিকার অতিরঞ্জন প্রকাশ প্রবণতা কিছুটা হলেও এতে লক্ষণীয়। ঘটনার বিবরণ পরিবেশনার ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা ও বিন্যাসের অভাব আছে। কিছু অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি করেছে।
কোনো বড় ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গ যদি সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেন বা স্মৃতিচারণমূলক কিছু লেখেন তা জাতীয় ইতিহাসের অনন্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে, যাঁরা ঘটনার বিষয়ে সাক্ষ্য দেন বা লেখেন, তাঁরা সবাই কী তা সৎ ও নিরপেক্ষভাবে দেন? অনেকে তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষায় প্রভাবিত হয়ে সাক্ষ্য দেন বা লেখেন। বিশেষত যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকেন তাঁদের পক্ষে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে যথার্থভাবে বিবরণ সম্পর্কে লেখা বা সাক্ষ্য দেওয়া কঠিনই বটে। কারণ নিজের অজ্ঞাতসারে তাঁরা অনেকেই হয়ে পড়েন পক্ষপাত দোষে দুষ্ট। তার পরও এ কথা বলা যায়, আনোয়ার উল আলম শহীদের স্মৃতিচারণামূলক বই একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় আমাদের ইতিহাসের অমূল্য উপকরণ। সব কিছু ছাপিয়ে তাঁর বইটি ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গবেষকদের কাজে লাগবে। নতুন প্রজন্মের যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাঁরা এই বইটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারবে।
রাশেদুর রহমান
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০
Leave a Reply