জেরার মুখে
বিপ্লবী নলিনীকান্ত সরকার একসময় বেশ কিছুদিন দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিতের কাছে আত্মগোপন করেছিলেন। নলিনীকান্ত দাদাঠাকুরের কাছে ছাপাখানা ও জঙ্গিপুর সংবাদ পত্রিকায় কাজ করার পাশাপাশি লুকিয়ে থাকা পলাতক বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বেশ কয়েকজন বিপ্লবীও মাঝেমাঝেই ছাপাখানায় আসতেন। নলিনীকান্তর সঙ্গে দেখা করবার জন্য। একদিন এক কনস্টেবল এসে নলিনীকান্তকে জানালেন, আপনাকে ইনস্পেকটরবাবু ডাকছেন।
ইনস্পেকটর প্রভাতচন্দ্ৰ দত্তর সঙ্গে নলিনীকান্তর রীতিমত ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রভাতচন্দ্র ছিলেন দাদাঠাকুরের বিশেষ বন্ধু। নলিনীকান্ত যে একজন বিপ্লবী এ কথা প্রভাতচন্দ্ৰ আগে অবশ্য জানতেন না। তবে জানা মাত্ৰই প্ৰভাতচন্দ্ৰ ডেকে পাঠালেন নলিনীকান্তকে। নলিনীকান্ত থানায় যেতেই ইনস্পেকটর প্রভাতচন্দ্র তাকে দুজন গোয়েন্দার সামনে বসিয়ে দিলেন। গোয়েন্দাদের কাছে গোপনসূত্রে খবর এসেছিল পলাতক বিপ্লবী গোপেশচন্দ্র রায় ছাপাখানায় এসে নলিনীকান্তর সঙ্গে দেখা করেন। সেইমত জেরা শুরু হল। কিন্তু গোয়েন্দারা কোনোভাবেই নলিনীকান্তর কাছ থেকে একটা কথাও বের করতে পারলেন না। তাঁরা নলিনীকে ছেড়ে দিলেন। এবার ডাক পড়ল দাদাঠাকুরের। পরনে ধুতি, গায়ে চাদর জড়িয়ে থানায় এসে দাদাঠাকুর বন্ধু প্রভাতচন্দ্ৰকে বললেন, ইনস্পেকটর বাবু, আমি এসে গেছি, কী দরকার বলুন।
প্রভাতচন্দ্ৰ দাদাঠাকুরকেও গোয়েন্দাদের জেরার মুখে বসিয়ে দিলেন। একজন গোয়েন্দা দাদাঠাকুরকে জিগ্যেস করলেন, নলিনীকান্ত সরকার নামে কেউ আপনার প্রেসে কাজ করে?
দাদাঠাকুর উত্তর দিলেন, হাঁ, কাজ করে।
গোয়েন্দারা প্রশ্ন করেন, কেমন লোক সে?
দাদাঠাকুর বললেন, এ তো অনর্থক প্রশ্ন! খারাপ লোক জেনে কেউ কি কাউকে নিজের কাছে রাখে?
গোয়েন্দারা বললেন, না না, সে ধরনের খারাপের কথা বলছি না। জানতে চাইছি, সে কি স্বদেশী?
দাদাঠাকুর জোর দিয়ে বললেন, আলবাৎ স্বদেশী!
গোয়েন্দারা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন, বটে! তা আপনি কী করে জানলেন ও স্বদেশী?
দাদাঠাকুর বললেন, ও স্বদেশী তো বটেই। ওর বাড়ি তো আমাদের একই মহকুমার নিমতিতা গ্রামে।
গোয়েন্দারা অসন্তুষ্ঠ হয়ে বললেন, না না, আপনাকে সেই স্বদেশীর কথা জিগ্যোস করছি না। এই যে এখন দেশে স্বদেশী আন্দোলন হচ্ছে, সেই সব দলের সঙ্গে ওর। কোনো যোগাযোগ আছে কি না জানেন?
দাদাঠাকুর বললেন, তাই বলুন, আপনারা স্বদেশী আন্দোলনের কথা বলছেন। তা হ্যাঁ, নলিনী ও দলে আছে এটা আমি জানি।
গোয়েন্দারা প্রশ্ন করলেন, ঠিক জানেন? আপনি এটা কেমন করে জানলেন?
দাদাঠাকুর উত্তর দিলেন, এ কথা তো সবাই জানে। ও স্বদেশী গান করে। এই তো কিছুদিন আগে দামোদর নদীর বন্যায় যখন বর্ধমান ভেসে গেল। তখন ও স্বদেশী গান গেয়ে টাকা তুলে সেখানে পাঠিয়ে দিল। হ্যাঁ, আর একটা কথা, শুনেছি কলকাতা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেও ওরা যোগাযোগ আছে।
গোয়েন্দারা এবার ক্ষেপে গিয়ে বললেন, না না, সে স্বদেশীর কথা জানতে চাইছি না। সে বিপ্লবী দলের লোক কিনা জানেন? যারা ইংরেজের রাজত্ব উচ্ছেদের জন্য খুন, জখম, ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে, আন্দোলন করছে, সংগ্রাম করছে, নলিনী সে সব দলে আছে কি না জানেন?
দাদাঠাকুর এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ও, বিপ্লবীদের কথা বলছেন? সে কথা তো আগেই বলতে পারতেন। তা হ্যাঁ নলিনী বিপ্লবীতো বটেই।
গোয়েন্দারা জিগ্যেস করলেন, কী করে জানলেন? দাদাঠাকুর বললেন, আমাদের দেশে একটা কথা চালু আছে–চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। ওর এক মাসতুতো ভাই বিপ্লবী শুনেছি, সেহেতু নলিনীও বিপ্লবী।
এবার গোয়েন্দারা জানতে চাইলেন, আপনার প্রেসে নলিনীর পরিচিত অথচ আপনার অপরিচিত এমন কোনো লোক আসে?
দাদাঠাকুর বললেন, আসে বৈকি! অবিশ্যি অবিশ্যি আসে। আলবৎ আসে।
গোয়েন্দারা জানতে চাইলেন, কেন আসে জানেন?
দাদাঠাকুর বললেন, কখনো নলিনীর পরিচিত আমার অপরিচিত, কখনো আমার পরিচিত নলিনীর অপরিচিত, কখনো উভয়ের পরিচিত বা অপরিচিতরা প্রেসে আসে কেউ বিয়ের, অন্নপ্রাশনের, শ্রাদ্ধের কার্ড ছাপাতে, কেউ চেক দাখিলা ছাপাবার জন্য। কত লোকই তো প্রতিদিন প্রেসে আসে। সবাইকে মনে রাখা যায়?
দাদাঠাকুরকে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে গোয়েন্দারা গোপেশচন্দ্রের বর্ণনা দিয়ে জিগ্যেস করলেন, বছর পাঁচিশ-ছাব্বিশ বয়স, চোখে চশমা, গায়ের রঙ কালো, ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি এ রকম চেহারার কেউ নলিনীর সঙ্গে দেখা করতে আপনার প্রেসে আসে?
দাদাঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, আসে তো।
গোয়েন্দারা জিগ্যেস করলেন, কী নাম তার?
দাদাঠাকুর বললেন, আজ্ঞে সুনীল। আমাদের সুনীল মোক্তার। সবেমাত্র ডাক্তারি পাশ করেছে। আপনারা যে রকম বৰ্ণনা দিলেন, ঠিক সেরকম দেখতে সুনীল মোক্তারকে। ও মাঝে মাঝেই আসে, এসে নলিনীর সঙ্গে গল্পগুজব করে।
গোয়েন্দারা যা জানতে চাইছিলেন, তা জানতে না পেরে হতাশ হয়ে দাদাঠাকুরকে ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেয়ে দাদাঠাকুর বন্ধু প্ৰতাপচন্দ্ৰকে বললেন, ইনস্পেকটরবাবু, আসি তাহলে।
থানা থেকে বের হয়ে দাদাঠাকুর মনে মনে গোয়েন্দাদের উদ্দেশ্যে বললেনবাপু, তোমরা চলো ডালে ডালে, আমি চলি পাতায় পাতায়। আমার পেট থেকে কথা বের করবে। এমন ক্ষমতা তোমাদের নেই হে!
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দাদাঠাকুর ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন করতেন। নলিনীকান্ত তাই নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে দীর্ঘদিন দাদাঠাকুরের কাছে ছিলেন।
Leave a Reply