লক্ষ্য ও আদর্শ
লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় একবার দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিতকে নিমন্ত্রণ করেন। মহারাজা বিখ্যাত ছিলেন দানশীলতার জন্য। দাদাঠাকুর লালগোলায় গেলেন মহারাজার আমন্ত্রণে। মহারাজা দাদাঠাকুরকে বিশেষভাবে খাতির যত্ন করলেন। দুজনে নানা বিষয়ে কথাবার্তা বলতে লাগলেন। মহারাজা দাদাঠাকুরের লেখা পত্রিকার পাতায় পড়তেন ও দাদাঠাকুরকে বিশেষ পছন্দ করতেন। দাদাঠাকুরও সম্মান করতেন মহারাজাকে। দুজনের কথাবার্তার মধ্যে কথা প্রসঙ্গে মহারাজা দাদাঠাকুরকে বললেন, পণ্ডিতমশাই, আপনি তো জঙ্গিপুর সংবাদ সাপ্তাহিক পত্রিকাটি চালাচ্ছেন, এই বিষয়ে আপনার যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও আছে। একটা কথা আপনার কাছে জানতে চাই, আপনার কাগজের চেয়ে বড় আকারের কাগজ, যাতে রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে লেখা থাকবে, এই রকম একটা সাপ্তাহিক কাগজ বের করতে হলে গোড়ায় কী রকম মূলধন দরকার হতে পারে বলতে পারবেন?
মহারাজার কথা শুনে দাদাঠাকুর ভাবলেন, মহারাজা হয়তো একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্ৰকাশ করবেন ঠিক করেছেন, তাই এই কথা জানতে চাইছেন। তখন দাদাঠাকুর বললেন, মূলধনের পরিমান হঠাৎ করে এখনই ঠিক বলা কঠিন। তবে নিজস্ব ছাপাখানা যদি থাকে তাহলে আনুমানিক পচিশ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে এই কাজে নামা যেতে পারে।
দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিতের রঙ্গ রসিকতা একথা শুনে মহারাজা দাদাঠাকুরকে বললেন, তা বেশ। এবার শুনুন, যে উদ্দেশ্যে আমি আপনাকে ডেকে এনেছি, আমি বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি কী করে আপনার জঙ্গিপুর সংবাদ কাগজখানাকে আরো উন্নত করা যায়। আসলে এই পরামর্শের জন্যই মূলত আপনার সাক্ষাতের প্রয়োজন ছিল। পণ্ডিতমশাই, আমি আপনাকে পাঁচিশ হাজার টাকা দিচ্ছি। আপনি আপনার কাগজখানাকে আরও উন্নত আরও বড় করুন। না না, এ টাকা ঋণ নয়।
মহারাজার এই প্রস্তাব শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাদাঠাকুর মহারাজাকে বিনীতভাবে বললেন, মহারাজ, আপনার এই অনুগ্রহ চিরদিন আমার স্মরণে থাকবে। কিন্তু আমারও যে কিছু বক্তব্য আছে। আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষেরই জীবনে একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য মানুষের একটা আদর্শকে অবলম্বন করা উচিত। সুতরাং আমার জীবনেও একটা লক্ষ্য ও আদর্শ আছে। আমার লক্ষ্য বড়লোক হওয়া এবং আপনার মত বড়লোক হওয়া। কারণ আমাদের জঙ্গিপুর মহকুমায় আপনিই সবচেয়ে বড়লোক। সেই জন্য আপনিই আমার আদর্শ। আমার প্ৰধান লক্ষ্য একদিন লালগোলার মহারাজের মত বড়লোক হব। মহারাজ, ভেবে দেখুন, আপনারাই কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে আমার এই লক্ষ্যে পৌঁছনো কি উচিত কাজ হবে?
দাদাঠাকুরের কথা শুনে মহারাজা মাথা নেড়ে বললেন, তা বটে, আপনি ঠিকই বলেছেন।
এরপর দাদাঠাকুর মহারাজকে প্ৰণাম জানিয়ে নিজের ছাপাখানায় ফিরে এলেন। দাদাঠাকুর অন্যের দান গ্রহণ করা পছন্দ করতেন না। তাঁর কাছে আত্মসম্মান ছিল সবচেয়ে বড়ো। তাই তিনি কোনো বিষয়েই কারোর কাছে মাথা হোঁট করেননি। নিজের যতটুকু সামৰ্থ, তাই নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন।
Leave a Reply