ট্যাক্সি
রসিক সাহিত্যিক ছিলেন দাদাঠাকুর। তাঁর প্রকৃত নাম শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিত। কিন্তু দাদাঠাকুর নামেই তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তিনি বিদূষক পত্রিকার সম্পাদকপ্রকাশক। শুধু তাই নয়, তিনি বাস্তায় ঘুরে ঘুরে নিজেই পত্রিকা বিক্রি করতেন। অন্যদিকে তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি। সময় সুযোগ পেলেই তিনি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে রঙ্গ রসিকতায় মেতে উঠতেন।
দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্ৰ পণ্ডিতের ভক্তের অভাব ছিল না। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাটর্নি নির্মলচন্দ্র তাঁর খুব বড় ভক্ত ছিলেন। দাদাঠাকুর ঘুরে ঘুরে পত্রিকা বিক্রি করেন দেখে নির্মলচন্দ্র একদিন তাঁকে বলেন, আপনি বিদূষক বিক্রি করার পর প্রতিদিন বিকেল পাঁচটার সময় আমার বাড়িতে বৈকালিক জলযোগ সারবেন।
সেই কথামত দাদাঠাকুর বিকাল পাঁচটায় জলযোগ সেরে আবার পত্রিকা বিক্রি করতে বের হতেন।
একদিন নির্মলচন্দ্রের বাড়িতে দাদাঠাকুরের নৈশভোজনের নিমন্ত্রণ হল। নির্মলচন্দ্রের মা-র একটি ব্ৰত উপলক্ষে এই নিমন্ত্রণ। নির্মলচন্দ্র দাদাঠাকুরকে তৃপ্তি করে খাওয়ালেন। খাওয়ার শেষে হাত মুখ ধুয়ে দাদাঠাকুর নির্মলচন্দ্রের মা-কে বললেন, বেশ খেলাম, এবার আসি, অনেক রাত হলো, আমাকে অনেকটা পথ যেতে হবে।
নির্মলচন্দ্রের মা তখন নির্মলচন্দ্ৰকে বললেন, বাবা নির্মল, দেখিস, পণ্ডিতমশাই যেন পায়ে হেঁটে বাড়ি না যান, উনাকে পাথেয় দিস।
মায়ের নির্দেশমত নির্মলচন্দ্ৰ দাদাঠাকুরকে ওয়েলিংটন থেকে বাগমারি পর্যন্ত তিন টাকা ট্যাক্সিভাড়া দিয়ে বললেন, পণ্ডিতমশাই, এত রাতে আপনাকে আর পায়ে হেঁটে যেতে হবে না, একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেবেন।
দাদাঠাকুর টাকাটা নিয়ে ট্যাঁকে গুঁজে রেখে প্রতিদিনের অভ্যাসমত পায়ে হেঁটেই ফিরলেন। পরের দিন গজেনদার আড়ডার আসরে এলে নির্মলচন্দ্রের সামনেই দাদাঠাকুর রসিকতা করে গতরাতের উপরি উপার্জনের কথা সকলের সামনে বললেন। নির্মলচন্দ্র অবশ্য সে দিন কিছু বললেন না।
এর কিছু দিন পরে নির্মলচন্দ্রের বাড়িতে আবার নৈশভোজের নিমন্ত্রণ হল দাদাঠাকুরের। খাওয়া দাওয়ার শেষে বাড়ি ফেরার সময় আগের দিনের মত নির্মলচন্দ্ৰ দাদাঠাকুরকে আবার তিন টাকা দিলেন এবং চাকরকে ডেকে বললেন, ওরে, দাদাঠাকুরের জন্য একটা ট্যাক্সি ডেকে দে তো, উনি বাড়ি ফিরবেন।
কথা মত চাকর ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। একপ্রকার বাধ্য হয়েই হাসতে হাসতে দাদাঠাকুরের। খাওয়া দাওয়ার শেষে বাড়ি ফেরার সময় আগের দিনের মত নির্মলচন্দ্র সকলের সামনে হাসতে হাসতে দাদাঠাকুরকে জব্দ করার কথা বললেন। দাদাঠাকুর সব শুনে মুচকি হেসে বললেন, আপনি ভাবছেন গতরাতে আমাকে জব্দ করেছেন! ভাবছেন আমাকে ট্যাক্সিতে পুরে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন! মোটেই না। কারণ আমি বাড়ি পর্যন্ত পুরো পথ ট্যাক্সিতে যাইনি। মেডিকেল কলেজের সামনে নেমে আটআনা ভাড়া দিয়ে ট্যাক্সিওলাকে বিদেয় করছি। এবার অঙ্ক কষে দেখুন। আপনি কত পারসেন্ট আমাকে ঠকিয়েছেন আর কত পারসেন্ট নিজে ঠিকেছেন।
এ কথা শুনে নির্মলচন্দ্ৰ বললেন, দাদাঠাকুর, সত্যিই আপনি ধন্য, কই পায়ের ধুলো দিন একটু।
অন্য শ্রোতারা আর না হেসে থাকতে পারেন?
Leave a Reply