কুর্দিস্তানের শ্রমিক দল পিকেকের আন্দোলন কুর্দিরা ইরাক, ইরান ও তুর্কি এই তিন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত সংবেদনশীল এই জাতিকে কেউ হজম করতে পারেনি। তিন দেশের শাসনকর্তারাও বরাবরই একটা বৈরী মনোভাব পোষণ করে এসেছে।
ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার এক শাখা ইরানি ভাষার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের একটা শাখা ভাষা হিসেবে বৃদ্ধি লাভ করে। এই ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে ওই অঞ্চলের বালুচ, গিলেকি ও তাইশ ভাষার সঙ্গে। ইরানি ভাষার দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের দক্ষিণী কুর্দি, লোরি ও বখতিয়ারি ভাষার সঙ্গে মূল কুর্দি ভাষার কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। এক বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চলে তিন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কুর্দিরা তাদের ভাষার মানভাষা তৈরি করতে পারেনি। তাদের ভাষা একাধিক উপভাষায় নিজেদের অবস্থান রক্ষা করে চলেছে। এসব উপভাষাকে সামগ্রিক কুর্দি ভাষা বলা হয়। ইরাকে কুর্দি এখন একটা দাপ্তরিক ভাষা। সিরিয়ায় এই ভাষা নিষিদ্ধ। সেখানে কোনো কুর্দি ভাষায় কিছু লেখা বেআইনি।
কুর্দি ভাষার বর্ণমালা এখনো তুরস্কে স্বীকৃতি পায়নি। তুর্কি ভাষায় এক্স, ডব্লিউ ও কিউ না থাকায় কোনো কুর্দি নাম এই বর্ণগুলো দিয়ে লেখা যেত না। শিক্ষাক্ষেত্রে বা রেডিও-টিভির সম্প্রচারে ২০০২ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত তুর্কি সরকার কুর্দি ভাষার ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করত। অন্যান্য দেশেও অনুরূপ বিধিনিষেধ রয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ রকম বিধিনিষেধ নেই। ইরানে বিশেষ কিছু অঞ্চল এবং বিশেষ সম্প্রচারের ক্ষেত্রে এই ভাষা ব্যবহার করা হলেও স্কুলে ব্যবহার করা হয় না।
২০০৬ সালের মার্চে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল কুর্দি ভাষায় সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। শিশু-কিশোরদের জন্য কার্টুন বা শিক্ষাবিষয়ক প্রোগ্রাম সম্প্রচার করা যেত না। সপ্তাহে চার ঘণ্টা বা দিনে ৪৫ মিনিটের জন্য সম্প্রচার বরাদ্দ ছিল। বর্তমান কুর্দি ব্লগ ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে কুর্দি সম্প্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ‘আমরা একই আকাশের নিচে বাস করি’ এই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কুর্দি ভাষায় সরকারি রেডিও ও টেলিভিশনে ২৪ ঘণ্টা সম্প্রচার শুরু হয়েছে। ওই সম্প্রচারের সময় বিতর্কিত বর্ণ এক্স, ডব্লিউ ও কিউ এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর কুর্দি ভাষা দিয়ে তুর্কি প্রশাসকদের কিঞ্চিৎ উদ্ধার মনোভাব দেখা যাচ্ছে।
যে ভাষায় মা শিশুর সঙ্গে কথা বলে, শিশুকে শেখায় বা সবক দেয়, সেই ভাষাই সেই শিশুর মাতৃভাষা। এ এক নাড়ির সম্পর্ক। স্বারূপ্যের এক শাব্দিক আবরণ যার আবেগ, অর্থ ও সম্পর্কের প্রকাশ ঘটে কণ্ঠের নির্দিষ্ট ধ্বনি দ্বারা। মাতৃভাষার প্রতি অনাদর এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিরোধিতার জন্য প্রায় তিন হাজার ভাষা আজ বিপন্ন। বেশ কিছু ভাষা মুমূর্ষু অবস্থায়। ভাষাবিদরা আশঙ্কা করেন আগামী ১০০ বছরে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক ভাষার মৃত্যু ঘটবে।
প্রতি এক পক্ষকালে একটি ভাষায় কথা বলার শেষ ব্যক্তিটি মারা গেলে সেই ভাষা শেষ হয়ে যায়। কানাডার ক্রি উপজাতির এক বর্ষীয়ান ব্যক্তি ডারিন স্পেন্স দুঃখ করে এই বলেন যে গির্জা-পরিচালিত আবাসিক স্কুলে তাঁদের মাতৃভাষা ব্যবহার করা হয় না, যদিও তা-ই হচ্ছে মূল। আমাদের নির্যাস ভাষায়, আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একাত্মশব্দ এবং আমাদের আত্মা এই ভাষাতেই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। এই মাতৃভাষার মাধ্যমেই আমাদের উপকথা ও কাহিনী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে আমরা এসেছি।
পয়লা মে ১৯২০ আধুনিক তুর্কি জাতির জনক কামাল আতার্তুক বলেছিলেন, ‘কির্কুকের উত্তরে রয়েছে কুর্দি এবং তুর্কিরা এবং আমরা কোনো দিন তাদের মধ্যে কোনো বৈষম্য করিনি।’ প্রকৃতপক্ষে বাকি বিংশ শতাব্দীতে তো বটেই এখনো কুর্দিরা বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার। নিপীড়নের ভয়ে প্রকাশ্যে অনেকে নিজেদের পরিচয় দেয় না। জেল-জুলুম ও বিতাড়ণ-নির্বাসনে জর্জরিত কুর্দিরা অনেক সময় প্রাণে মারা গেছে বেঘোরে।
কুর্দিরা বিদ্রোহের পর বিদ্রোহ করেছে। ১৯৮৪ সালে সবচেয়ে মারাত্মক বিদ্রোহ দেখা দেয় নিষিদ্ধ কুর্দিস্তান শ্রমিক দলের পিকেকে-এর নেতৃত্বে। এই বিদ্রোহে প্রায় ৪০ হাজার কুর্দি প্রাণ হারায়। রাষ্ট্রের লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয়। আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি হয় এক রুগ্ণ গণতন্ত্রের।
বিভিন্ন তুর্কি নেতারা এ সমস্যা সম্পর্কে নিম্নকণ্ঠে আলোচনা করলেও মারমুখো সেনাপতিদের সম্মুখে উচ্চকণ্ঠ হতে পারেনি। সেনাপতিদের কথা, সংখ্যালঘুদের আশকারা দিলে তুর্কির সংহতি ব্যাহত হবে। বিভিন্ন যোগাযোগের কারণে বর্তমান তুর্কি সরকারের অনেক বেশি সচেষ্ট হয়েছে বহু পুরাতন সমস্যার সমাধানকল্পে। ২০০৯ সালের আগস্টে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী এরদোগান পার্লামেন্টে বলেন, তুর্কি-কুর্দি সংঘর্ষে একই বেদনায় ক্লিষ্ট তুর্কি ও কুর্দি মায়েরা যারা তাদের সন্তান হারিয়েছে। এই বক্তব্যে পার্লামেন্টে অনেকেই অশ্রুভারাক্রান্ত হয়। তুর্কি প্রধানমন্ত্রী কথা বলেন, পিকেকের রাজনৈতিক ফ্রন্ট ডিটিপি ডেমোক্র্যাটিক সোসাইটির নেতা আহমেদ তুর্কের সঙ্গে। কুর্দি ভাষার ওপর এবং কুর্দি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ওপর বিধিনিষেধ কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কুর্দিরা তাদের নিজের নাম এখন নিজের ভাষায় লিখতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কুর্দি বিভাগ খোলা হবে। যেসব কুর্দি তরুণ শুধু স্লোগান উচ্চারণের জন্য বা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোড়ার জন্য জেল বা হাজতে ছিল তাদের মুক্তি দেওয়ার কথা উঠেছে। যাদের সন্তানেরা হারিয়ে গেছে তাদের পিতামাতা আশা করেন, এবার তাদের ছেলেরা ঘরে ফিরবে। রহস্যময় খুনের অনেক ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে। কুর্দিদের বাস্তব রাজধানী দিয়ারবাকিরে রাস্তায় রাস্তায় কুর্দি ভাষায় স্লোগান দেখা যাচ্ছে ‘আবর্জনা ছড়িও না’। এই শহরের কারাগারে কুর্দি বন্দীদের তাদের নিজের মল খেতে নাকি বাধ্য করা হতো।
প্রচারমুখী পিকেকে-র নেতা আবদুল্লাহ ওচালানের সঙ্গে কীভাবে কথা পাড়া যায় সরকার পক্ষে তা-ই সবাই চিন্তা করছে। আত্মকেন্দ্রিক পিকেকে-র নেতা বলছেন তিনি তাঁর নিজস্ব শান্তিপথের মানচিত্র তৈরি করবেন। এবার জেনারেলরাও নানা কারণে রফা করতে চায়।
ইরাকে মার্কিন সৈন্য অপসারণ করা হলে ইরাকি কুর্দিরা তুর্কির সহযোগিতা কামনা করতে পারে এবং পিকেকে যোদ্ধারাও অস্ত্র ত্যাগ করতে পারে। নতুন প্রজন্মের ক্ষুব্ধ তরুণেরা যেকোনো সময় একটা বিস্ফোরক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে, সবাই খেয়াল করছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমালোচনা যে তুর্কি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর প্রতি যথাযথভাবে মানবিক আচরণ করছেন না এবং ইউনিয়নের স্থায়ী সদস্য পদ পেতে হলে তুর্কিকে কিছু ছাড় দিতে হবে। বহু দশক পরে মনে হচ্ছে কুর্দি সমস্যার একটা সমাধান দেখা যাচ্ছে। এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না।
কুর্দি কবি বাখতিয়ার ওয়াহাবজাদের কবিতায় এক বিষণ্ন ভাব লক্ষ করা যায়—
‘কুর্দি ভাষায় পাণ্ডুলিপি, ইতিহাস ও চিঠিপত্র সব লেখা ছিল—
রোজকেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা না করে
আমাদের মোল্লা, শেখ, রাজা ও রাজকুমাররা যদি তা স্বীকার করে নিতেন!
বোলো না কুর্দি ভাষা বচনপটু নয়
এর বাকসৌন্দর্যের সঙ্গে কোনো ভাষার তুলনা হয় না
কুর্দিদের অনীহার জন্যই এটা আকর্ষণীয় মনে হয় না।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ২১, ২০১০
Leave a Reply