আমার মেয়ের বয়স তখন চৌদ্দ, যেদিন তার মা ও আমার স্ত্রী আমাদের সামনে ঘোষণা করল, সে এখন অন্য পুরুষকে ভালোবাসে।
‘বেশ মজাদার সংবাদ তো!’ আমি বললাম। ‘একই সঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি তাকে ভালোবাসবে দূর থেকে এবং আমাদের খাওয়াতে থাকবে ঘরে তৈরি কাটলেট, নাকি ভালোবাসার পাত্রকে কাটলেট খাওয়াতে তার কাছে যাবে?’
‘তোমরা আমার প্রিয়জন, তোমাদের সারা জীবন ভালোবাসব। আর আমার নতুন প্রেমিক কাটলেট খায় না। আমি কিছুদিনের জন্য তোমাদের ছেড়ে থাকব।’
‘আমি যদ্দুর বুঝি,’ বললাম আমি, ‘প্রেম হতে পারে দুরকম, হয় তা সারা জীবনের জন্য নয়তো তা কোনো পদেরই নয়। কিছুদিনের জন্য, এর মানে কি চিরদিন?’
‘প্রেম হতে পারে উন্মত্ত, আবার তা প্রেমপদবাচ্য নাও হতে পারে। অতএব দয়া করে গাধার মতো প্রশ্ন কোরো না। নয়তো আমি ভেবে বসব আমার প্রতি তোমার প্রেম কোনো পদেরই ছিল না।’
আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েকে চুমু খেয়ে, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেল সে।
‘আচ্ছা, বাবা,’ মেয়ে বলল, ‘মার মতো মহিলাকে বিয়ে করার সময় তুমি কী ভেবেছিলে, বলো তো?’
‘মানে?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
‘না, মা মানুষ হিসেবে ভালো, তবে একেবারেই দায়িত্বহীন এবং লঘুচিত্ত।’
আমি বললাম, ‘পরম দুঃখের কথা এই যে তোমার সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সময় আমার সব সময় থাকে না।’
এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে মেয়ে বলল, ‘সত্যিই দুঃখের কথা।’
চার বছর পরের ঘটনা। উষ্কখুষ্ক ঝাঁকড়া চুলওয়ালা এক ছেলেকে নিয়ে এল সে বাসায়। ছেলেটার পরনের পোশাক দেখে মনে হলো, গতকালই মাত্র ধুয়েছে, তবে ইস্ত্রি করার সময় মেলেনি।
‘আমরা বিয়ে করতে চাই,’ মেয়ে বলল। ‘তোমার কী মতামত, বলো।’
‘নেতিবাচক,’ বললাম আমি। এবং বিশদ জানার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলাম না।
‘খুবই দুঃখের কথা,’ মেয়ে বলল, তারপর চলে গেল তারা দুজন।
পরবর্তী ঘটনাবলি গতানুগতিক। আমার মেয়েটা হয়ে পড়ল স্বামীহীন, তবে স-সন্তান। তাড়াহুড়োর মধ্যে তারা শিশুটার নাম রাখতে ভুলে গিয়েছিল। আমি রেজিস্ট্রি করে নিয়ে এলাম তার নাম—ইভান। ক্ষতবিক্ষত হূদয়টির শুশ্রূষা করতে আমার মেয়ে তখন ছিল দক্ষিণাঞ্চলের অবকাশ যাপন কেন্দ্রে।
‘ইভান?’ আমার কাছ থেকে সংবাদ পেয়ে সে বলল। ‘নামটা খুব পছন্দের নয় আমার। আমি তার নাম রাখতে চেয়েছিলাম দেনিস।’
আমি বললাম, ‘পরম দুঃখের কথা এই যে তোমার সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সময় আমার সব সময় থাকে না।’
কিছুদিন বাদে ফিরে এল তার মা এবং আমার স্ত্রী। ফলে ইভানের পর্যাপ্ত পরিচর্যার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর আমার মেয়েটা বিয়ে করল অতীব ব্যস্তবাগিস এক লোককে। আমাদের কন্যা আর ইভানের মার দেখা পাওয়া যেতে লাগল কদাচিৎ।
ইভানের বয়স যখন বারো হলো, আমার তখন হলো অসুখ। এক খেপা ডাক্তার পরামর্শ দিল অপারেশন করানোর। আমি করালাম। কিন্তু তা সফল হলো না। আমার বাগ্যন্ত্রে গড়বড় দেখা দিল। আমি কথা বলতে পারি না।
‘তুমি যে কেন এই অপারেশন করাতে রাজি হয়েছিলে!’ একদিন আমাকে দেখতে এসে আমার মেয়ে বলল।
আমি উত্তর দিলাম না। যদি দিতে পারতাম, তা হলে, আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, তাকে বলতাম আমার প্রিয় হয়ে ওঠা বাক্যটি, ‘পরম দুঃখের কথা এই যে তোমার সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সময় আমার সব সময় থাকে না।’
এবং যেদিন আমার সঙ্গে ঘটবে সেই অনিবার্য ঘটনাটি, যা ঘটে থাকে সবার ক্ষেত্রেই, কিছুদিন আগে আর পরে, আমার ধারণা, আমার কন্যা এই রকম একটি কথা বলবে, ‘কেন তুমি এত তাড়াতাড়ি আমাদের ছেড়ে চলে গেলে?’
আমি তখন ঝাড়ব মোক্ষম এই বাক্য।
মেয়েটা এখন আশপাশে নেই। কোথায় কোথায় জানি ঘুরছে পাগলের মতো। সুখের অন্বেষণে।
আমি আমাদের দ্বিতীয় নাতিকে বড় করছি। কী নাম দেব তার? তাকে সুখী বানানোর উপায় কী?
‘পরম দুঃখের কথা এই যে, তোমার সঙ্গে সলাপরামর্শ করার সময় আমার সব সময় থাকে না,’ কথাটা যে কার উদ্দেশে বললাম!
–সংকলন ও অনুবাদ: মাসুদ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ০৫, ২০১২
Leave a Reply