আসমা বীথির প্রথম কবিতার বই আধখাওয়া ফলের জীবনী। দুটি পর্বে বিভক্ত এ বইয়ের দ্বিতীয় পর্ব ‘সমুদ্র ও কয়েকটি দিন’-এর শেষ কবিতাটি উদ্ধৃত করলেই স্পষ্ট হয় কবির মৌলস্বর—‘ঢেউয়ের পর ঢেউ/কত দূর হতে ভেসে আসে উন্মত্ত স্বর/বেঘোর অন্ধকার/উপরে/নিচে/চারধার/ আধখাওয়া ফলের জীবনী লিখে রেখেছ তীরে/ঢেউ আসে।/মিলিয়ে যায়’(‘রাতে, সমুদ্রে’)
বইয়ের এক কম চল্লিশটি কবিতায় সমুদ্র ও পাহাড়, গ্রাম ও শহর, আলো ও অন্ধকার, গ্রীষ্ম ও বসন্ত, বাস্তব এবং রূপকথার দৃশ্য এঁকে চলেন কবি। সমুদ্রতীরে আমরা তো কত কিছুই ফেলে আসি—ডাবের খোসা, আধখাওয়া ফল কিংবা অর্ধেক বেদনা। আসমা বীথির কবিতা মূলত আসা-যাওয়ার পথের ধারে ফেলে আসা বিষয়ের কবিতা। কেঁচো ক্লিন্ন জীবনের চকিতচিত্র তিনি যেন সবার অগোচরে দ্রুত শব্দবন্দী করেন। অধিকাংশ কবিতা তাই খুব সহজে পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে। যোগাযোগ বলতে ঐক্যের অনুভবকে বোঝাচ্ছি। এ ঐক্য বিরূপ বিশ্বে নিয়ত একাকী মানুষের বিপন্ন বিস্ময়ের, মর্মে নিহিত সোনালি-রক্তিম কারুকাজের। নানা গার্হস্থ্য চিত্রের সমাহার তাঁর কবিতায়। এ চিত্র মোটেও লাবণ্যভারাতুর নয়। বরং তা মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েনের চেহারাও বাঙ্ময় করে—‘তোকে কে দেবে জায়গা? একটু সুযোগ?/পুরোটাই চোরাবালি, ভুবন রঙিন/এক ফাঁদ। বিকানোর পদ্য না থাকলে/জানা, বুঝি তুই খুকি, কামিজের আড়ালে/লুকিয়ে বয়স! অধিকার-আবদারে/নিখুঁত আহ্বান, এই বুঝি হলো; না না/খুকি তো, বুঝিস না অফার! কর্পোরেট/গেলা নিউজ, রাত-জাগা ককটেলের ভার/কী করেই বা নেবে তোর পলকা শরীর?/(‘সংবাদ পাঠক হতে চেয়ে’)
কাব্যিক প্রসাধনের দিকে তেমন কোনো দৃষ্টি না দিয়ে এমনতর দুর্ধর্ষ উপলব্ধির মুখোমুখি করতে পারেন আসমা বীথি। রঙিন দুনিয়ায় বিকোবার সহজ পন্থা না জানা থাকলে যে কিচ্ছু মেলে না, সে বাস্তব আমাদের সামনে কবিতার চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
আবার কোনো কোনো কবিতায় সাধারণ কিছুর মধ্য দিয়ে এমন অনন্য অনুভব চারিয়ে দেন কবি, তখন ‘মাছ-কাটুরে’ কবিতার বর্ণনার মতো আমরাও ভাবতে থাকি বাজারে কাটতে থাকা মাছের কোন পাশটা রসনায় স্বাদ এনে দেবে—‘বুক না কি হূৎপিণ্ডের টুকরোখানি।’
বীথির শব্দসজ্জায় অতি প্রচলিত ‘গেরস্থালি মেঘ’-এর ব্যবহার যেমন ক্লিশে শোনায় বিপরীতে ‘রাতের রিংটোন’ অপ্রচলিত হলেও শ্রুতিমাধুরী তৈরি করে যায়। তবে শব্দশ্রী, আঙ্গিকব্যঞ্জনা ইত্যাদি নিয়ে আধখাওয়া ফলের জীবনীর কবি যে খুব সচেতন তা মনে হয় না। কবি যেন সাদা চোখে তার দৃশ্যমানতা শুধু কবিতানাম্নী দিনলিপির পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাঁর দিনলিপিতে শুধু ব্যক্তি ও তাঁর একান্ত অনুভূতিমালাই নয়, বরং বিশাল বহির্বাস্তবও উঁকিঝুঁকি দেয়—‘সপ্তাহ ঘুরে এই দোতলা, বোকা বয়/জরুরি অবস্থা ভেঙে আয়নাঘর, সিঁড়ি/মুখোমুখি কত বর্ষা, শীত…’ (‘এশিয়ান স্পাইস’) বা ‘অন্যদেশের খবর আনমনে শুনি/দেখি আহত, মৃত মুখের সারি’ (‘সম্প্রচার বন্ধ হলে’) অথবা ‘কোথাও হয়তো দাঁড়িয়েছ তুমি/কমে এসেছে রাস্তার জল/এদিকে অভয়মিত্র ঘাটে/নামগোত্রহীন কারও লাশ/ভেসে ওঠে’ (‘কামিজে লেখা কবিতা’)
জরুরি অবস্থা, ভিনদেশে আহত মৃত-মুখের সারি আর ঘরের পাশের লাশবাস্তবতা—এগুলো যেন কবির কাছে সংবাদপত্রের শিরোনামের মতোই শুষ্ক, প্রাত্যহিক। তাই অবলীলায় কবিতার কোমলগান্ধারের ভেতর ঢুকে পড়ে ইত্যাকার পাষাণ।
জীবনকে বীথি নানান প্রেক্ষণিতে দেখেন। জীবন তাঁর কাছে কারও স্পর্শে ছলকে ওঠা পানপাত্র। কখনো জীবন যেন পথে পথে বাসা বাঁধা ‘জীবাণুর সংসার’ আবার জীবন কখনো বা তাঁর কাছে ধরা দেয় নেহাত আঙুল-পরিধির প্রতিমায়। জীবনের কথা বারংবার আসে, কারণ মূল্যবান মানবজীবন আজ নিদারুণ ক্ষয় আর মালিন্যের রেখায় লুপ্ত।
সমুদ্র আধখাওয়া ফলের জীবনীর কেন্দ্রধ্রুবা। কবি তাঁর যাপিত পৃথিবীর বিপুল দাবদাহ নিয়ে সমুদ্রের কাছে যান। এমনকি এর আগে অনেকে আগুনের জাহাজে করে সমুদ্রে গিয়ে আর ফিরে আসেনি জেনেও মানুষের সমুদ্রগামিতা শেষ হয় না। সমুদ্রকে কবি অনায়াসে ‘ভাই’ বলে ডাকেন। সমুদ্রের সঙ্গে এ বইসূত্রে আমাদের সন্দর্শন ঘটে নানা ভঙিতে—
‘আমাদের সমুদ্রগামী বাসের চালক দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বেজন্মা কুকুরের উদ্দেশে খানিক গালমন্দের পর পুনরায় স্টার্ট দিল গাড়ি। আমি ভাবছিলাম, এরকম বৃষ্টির দিনে কখনও সমুদ্র-দর্শন হয়নি।’ (‘সমুদ্রপথে’);
‘ঢেউয়ের গভীরে কাটা ছিল গোপন খাল/ঢেউ কি জানত/মনে শতেক ডানা, জলের অভূত ফোয়ারা’ (‘গুপ্তখাল’); ‘সামনে সমুদ্র নিয়ে আছি, পেছনে পাগলের প্রলাপ’ (‘সমুদ্র ও পাগল’); ‘আর সমুদ্র পাড়ের ক্যামেরাম্যান/তুলে যাচ্ছে ছবি, লিখে নিচ্ছে একের পর এক/ ঠিকানা; সব ছবি কি পায় প্রাপক?’ (‘খসড়াদৃশ্য’)
সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে যেমন আমরা নিজেদের প্রকৃত দর্পণ খুঁজে পাই, ঠিক তেমনই এসব সমুদ্রকেন্দ্রিত কবিতামালায় দেখব সব আড়াল ভেঙে জীবনের নিগূঢ় চালচিত্রের উদ্ঘাটন। এটা সত্যি যে, সমুদ্রের পেছনে আমাদের দিনানুদৈনিক জীবন যেন পাগলের প্রলাপ মাত্র। আবার এও সত্যি আমাদের বুকের ভেতর গুপ্ত আছে ‘জলের অভূত ফোয়ারা।’ এ ফোয়ারা প্রায়শ রুদ্ধই থাকে। আসমা বীথির ‘সমুদ্র ও কয়েকটি দিন’ অংশের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমাদের ভেতরের ঘুমন্ত ফোয়ারা জেগে উঠতে পারে। তখন ব্যবহূত হতে হতে শূকরের মাংস হয়ে যাওয়া জীবন তার গায়ে জমা ধুলোর পাহাড় ফেলে আসতে পারে সমুদ্রে; যেখানে হাওয়ার নূপুরের তালে প্রেতিনিরাও দুঃখ ভুলে নাচে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply