একবার মুর্শিদাবাদের নবাবের খেয়াল হল, হিন্দুদের মত আমাকে নিয়ে মহাভারত রচিত হোক। যেমনি ভারা তেমনি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে নির্দেশ পাঠালেন, আপনাদের অর্থাৎ হিন্দুদের অনুকরণে, তাকে নিয়ে একটি নতুন মহাভারত পন্ডিতদের দিয়ে লিখে দিতে হবে একমাসের মধ্যে। সেইরূপ পন্ডিত অতি শীঘ্র নবাব দরবা পাঠান। যিনি রচনা করবেন তাঁকে প্রচুর আসরাফি পুরষ্কার দেওয়া হবে।
নবাবের চিঠি পেয়ে মহারাজ এমন চিন্তায় পড়লেন যে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন। কারণ এমন কে পন্ডিত আছে যে, সে হিন্দুদের মত করে মহাভারত লিখে দিতে সক্ষম হবে। গোপাল বাহিরে গেছিল কয়েকদিন, সেদিনই রাজসভায় এসেছে- এসে মহারাজকে রাজসভায় উপস্থিত হতে না দেখে খবর নিয়ে জানতে পারল যে, মহারাজ নাকি এক বিষয় নিয়ে খুব চিন্তিত আছেন, সেজন্য রাজসভায় আসেন নি। কিন্তু বিষয়টা কি সে সম্বন্ধে কেউই কিছু বলতে পারল না। গোপালের সব জায়গায় এমন কি অন্দরবহলেও অবারিত দ্বার, সেজন্য অন্দরমহলে গিয়ে মহারাজকে পাকড়াও করল। অন্দর মহলে গোপালকে দেখে মন ক্ষুন্ন হলেও একদিকে প্রিয় বয়স্য অন্যদিকে বিপদে আপদের বুদ্ধিদাতা গোপালকে দেখে মনে একটু ভরসা পেলেন, এই মনে করে যে, এই বিপদের সময় আর কিছু না হোক গোপাল হয়ত একটু বুদ্ধি বাতলে দিতে সক্ষম হবে। গোপালের কাছে অকপদে সমস্ত খুলে বললেন নবাবের খেয়ালের কথা।
মহারাজের মুখে সমস্ত শুনে গোপাল বলল এই সামান্য কথার জন্য এত ভাবনা চিন্তা না করে আমার উপর ছেড়ে দিন। আমাকে পাঠাচ্ছেন বলে চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে আপনি নিশ্চিন্তে খান দান ঘুমোন। যা করবার আমি করব। মহারাজ গোপালের উপর বিশ্বাস করে নবাবের কাছ চিঠিও গোপাল কে পাঠিয়ে দিলেন। গোপাল গরদের কাপড় পরে, উড়নী গাড়ে দিয়ে, গলায় বড় বড় তুলসীর মালা ঝুলিয়ে কপালে তিলকের ফোঁটা কেটে মাথায় মস্ত টিকিতে একটা বড় ফুল বেঁধে নবাব দরবারে দিয়ে উপস্থিত হলো। মহাপন্ডিত গোপালকে নবাব দেখে খুব খুশি হলেন। কুর্নিশ করে গোপাল বললে, নবাব বাহাদুর আপনি যদি পাচঁ হাজার টাকা খরচ করেন তবে একমাসের মধ্যে আপনার মনের মত মহাভারত তৈরী করতে পারবে। এর কম সময়ে হবে না এবং এর জন্য কোন ভাবনা চিন্তা করবেন না।
নবাব গোপালের কথা শুনে বললেন, পন্ডিত মশায় আপনাকে পাঁচ হাজার কেন আমি দশ হাজার টাকা দেব, আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন মহাভারত লিখে শেষ করুন। এই বলে গোপালকে দশ হাজার টাকা দিয়ে দিলেন। গোপাল একমাসের সময় নিয়ে মহাভারত লেখা আরম্ভ করে দিল।
নবাবের ঘন ঘন তাগাদার পর আঠাশ দিনের মাথায় নবাবের মহাভারত হাজির হয়ে পন্ডিত মশায় বললেন, নবাব বাহাদুর মহাভারত লেখা প্রায় অন্তিম পর্যায়, খালি একটা বিষয়ে আটকে আছে, সেটা হচ্ছে, আমাদের মহাভারতে দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী যধীষ্ঠীর, ভীম, অর্জুন, নকুলও সহদেব নামে খ্যাত। সে সব ত উপস্থিত সকলেই আপনারা জানেন। কিন্তু আপনার বেগম সাহেবার পঞ্চ স্বামীর কি কি নাম তা আমার জানা নেই। আপনি বললেই লিখে দেব এবং আমার লেখা মহাভারত এ সমাপ্ত হয়ে যাবে। এখন বলুন নবাব সাহেব আপনার বেগম সাহেবার পঞ্চস্বামীর নাম কি কি ।এইটুকু ছাড়া আর সব লেখা শেষ হয়ে গেছে। এই নামগুলি বসিয়ে দিলেই আপনার মনের মত মহাভারত সম্পূর্ণ সমাপ্ত হয়ে যাবে।
নবাব বাহদুর এ কথাশুনে তোবা তোবা করে, কানে হাত দিয়ে বললেন, এ কি কথা বলছেন পন্ডিত মশায়! আমার বেগম সাহেবার কি কখনও আমি ছাড়া কোনও স্বামী থাকতে পারে! দরবারে এত লোকের সামনে এই কথা শুনে নবাব লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে বললেন, আমার আর মহাভারতের দরকার নেই, আপনি এখন আসতে পারেন পন্ডিত মশায়।
গোপাল করজোড়া প্রার্থনা করে বলল, সে কি নবাব বাহাদুর আমি এত কষ্ট করে একমাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করে কতভেবে চিন্তে মহাভারত লিখলাম আপনি বাতিল করে দিলেন। মহানুভব নবাব একথা শুনে পন্ডিত মশাইকে বললেন, আপনি কষ্ট করে লিখেছেন সেজন্য আপনাকে পারিশ্রমিক দ্বিগুন করে দিচ্ছি। আপনি পারিশ্রমিক নিয়ে মহাভারতের নাম মুখে না এনে বাড়ি চলে যান। এই বলে খাজাঞ্চিকে ডেকে টাকা দেওয়ার আদেশ দিলেন।
খাজাঞ্চি টাকা দিলে গোপাল আনন্দ চিত্তে দিয়ে হাজির হলো মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজ সভায়। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালের মহাভারত লেখার কাহিনী শুনে খুবই আনন্দিত হলেন, কারণ এমন বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে মনে মনে খুব আনন্দিত হলেন। গোপাল আর এক দফা পুরষ্কার পেয়ে আনন্দিত হল। মহারাজ গোপালকে বললেন তোমার তুলনা তুমিই। তুমি এ যাত্রায় রক্ষা না করলে আমি খুবই অসুবিধায় পড়তাম। যাক এ যাত্রা থেকে মুক্তি পেলাম।
পূর্ববর্তী:
« নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেয়ার
« নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেয়ার
পরবর্তী:
নবাবের জুতা »
নবাবের জুতা »
Leave a Reply