জানেন, সম্প্রতি আমার একটি উপলব্ধি হয়েছে: একেবারেই তুচ্ছ কোনো ব্যাপার অবলীলায় নষ্ট করে দিতে পারে তীব্র ও বিশুদ্ধ কোনো অনুভূতি। এই যেমন আমার কথাই ধরুন। বহুদিন ধরে বিয়ে করার খায়েশ মনে; যদিও সেটা নিয়ে খুব লজ্জিত থাকি। হয়তো কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো, কিন্তু এরপর কী করা প্রয়োজন, তা আমার জানা নেই।
তবে এই মেয়ে, গালিয়া, এতই সোজাসাপ্টা গোছের যে আমাদের সম্পর্ক বহুদূর পর্যন্ত গড়াল। একদিন সে আমার বাসায় বেড়াতে এল। আমরা দুজন সারাটা সন্ধে কাটালাম তরমুজ খেয়ে। তরমুজটাও ছিল অপ্রতিরোধ্য রকমের সুস্বাদু। আমি বড় বড় চার টুকরো খেয়ে ফেললাম। তারপর গালিয়াকে তার বাসায় পৌঁছে দিতে গিয়ে বুঝলাম, অত তরমুজ খাওয়া আমার উচিত হয়নি। কিন্তু এখন আর ভেবে কী লাভ! দেরি হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে আমি রাস্তার দুই পাশে তাকাতে থাকলাম। চারদিকে বড় বড় বাড়ি, অথচ আমার প্রয়োজন ছোট্ট একটি ঘর এবং সেটি কোথাও নেই! বিষণ্নতা পেয়ে বসল আমাকে। এমন কি গালিয়াও সেটি লক্ষ করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু হয়েছে তোমার?’
আমি বললাম, ‘হয়নি, তবে হতে পারে।’
সে বলল, ‘আমরা এত দ্রুত হাঁটছি কেন? তোমার হাতে কি সময় কম? হয়তো আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার সময় তোমার নেই, তাই না?’
আমি বললাম, ‘পৌঁছে দিতে পারব, তবে ধীরে হাঁটতে পারব না।’
সে বলল, ‘তোমার যখন এতই তাড়া, তা হলে চলো, বাসে চেপে যাই।’
‘না,’ বললাম আমি, ‘বাসে অনেক লোক। ভিড়ের মধ্যে আমার শরীরে চাপ পড়তে পারে।’
সে কিছুই বুঝল না। আমরা আগের মতোই দ্রুতগতিতে হাঁটতে থাকলাম। ছোট ঘর নেই কোত্থাও। আছে পুলিশের বুথ। সেখানে গিয়ে আমি বললাম, ‘মিস্টার লেফটেন্যান্ট, এখানে আশপাশে কোথায়…ইয়ে…প্লিজ, নিচু স্বরে বলুন, নয়তো আমার বান্ধবী শুনে ফেলবে।’
লেফটেন্যান্ট বলল, ‘নিচু স্বরে কেন? কোনো অপরাধ করেছেন নাকি?’
আমি বললাম, ‘করিনি, তবে করতে চলেছি বোধহয়।…না, আপনি আমাকে বুঝতে পারেননি। সবারই এমন হতে পারে কিন্তু। ধরুন, আপনি আপনার বান্ধবীর সঙ্গে যাচ্ছেন কোথাও। হঠাৎ প্রবল ইচ্ছে হলো বিশেষ একটা কাজের। কিন্তু কাজটি আপনি রাস্তায় করতে পারবেন না। হয়নি এ রকম?’
সে বলল, ‘হতো, যখন সাধারণ পুলিশ ছিলাম।’
তখন আমি গালিয়ার হাত ধরে প্রায় দৌড়াতে শুরু করলাম। একটা বাড়ির সামনে গিয়ে ওকে বললাম, ‘তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো। আমি বন্ধুর বাসায় যাব আর আসব।’
লিফটে ঢুকতেই লিফট-মহিলা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কার কাছে যাচ্ছেন?’
আমি বললাম, ‘হলেই হলো। শুধু লোক ভালো হলেই চলবে।’
সামনে যে ফ্ল্যাট পড়ল, সেটাতেই কলবেল বাজালাম। দরজার পেছন থেকে প্রশ্ন ভেসে এল নারী কণ্ঠে:
‘কে?’
আমি বললাম, ‘খুলুন, নিজেদের লোক।’
মেয়েটি প্রশ্ন করল, ‘নিজেদের লোক মানে?’
আমি চিৎকার করে বললাম, ‘নিজেদের, মানে সোভিয়েত। দরজা খুলুন, নইলে খুব খারাপ হবে।’
সে বলল, ‘যখন খারাপ হবে, তখনই বরং আসবেন।’
আমি ফেরত গেলাম গালিয়ার কাছে। আমরা প্রায় দৌড়ে গেলাম তার বাসা পর্যন্ত। ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। ওর মা আমাদের দেখে বললেন, ‘এসো, এখন আমরা চা খাব।’
আমি বললাম, ‘আপনি আমাকে দেখতে পারেন না কেন?’
তিনি বললেন, ‘চা খেতে না চাইলে তরমুজ খাও।’
এরপর কী হয়েছিল, সে বর্ণনা দেব না। শুধু বলি, তুচ্ছ এই ঘটনার কারণে মৃত্যু হলো তীব্র ভালোবাসার।
প্রেমিক-প্রেমিকার সুবিধার জন্য কী না করা হয়! তাদের জন্য আছে বিয়ে রেজিস্ট্রির অফিস, বিয়ে উদ্যাপনের জন্য প্রাসাদ, মাতৃসদন। অথচ ভালোবাসা নামের এই অনুভূতির সুরক্ষার কথা চিন্তা করে প্রতিটি রাস্তায় ছোট্ট একটি ঘর নির্মাণ করা হলে কত ভালোই না হতো!
পূর্ববর্তী:
« বিষ মিশিয়ে নিতে পারেন।
« বিষ মিশিয়ে নিতে পারেন।
পরবর্তী:
বিসর্জন মহড়ায় »
বিসর্জন মহড়ায় »
Leave a Reply