একেবারেই আচম্বিতে ঘটল ঘটনাটা। আমি চোখ তুলে মেয়েটির দিকে তাকালাম প্রথমবারের মতো। সে মুচকি হাসল। এবং এভাবেই শুরু হলো প্রথম দর্শনেই প্রেম।
মেট্রোর বগিটা ঝাঁকুনি দিচ্ছিল বেশ। মেয়েটি বসে ছিল আমার উল্টোদিকের সিটে এবং মুচকি মুচকি হাসছিল। কেউ কোনো দিন আমার দিকে তাকিয়ে ওভাবে হাসেনি। অর্থাৎ এটাই প্রেম? এর মানে, বিদায়, আমার ব্যাচেলর জীবন? এর মানে…যাক গে, যা হওয়ার হবে। আর কাঁহাতক বাইরের খাবার খাওয়া যায়! যথেষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমরা থাকব কোথায়? আমার ওখানে তো জায়গা এমনিতেই কম। তা হলে ওর ওখানেই থাকব বরং। ঘরে থাকবে শুধু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। জানালার পাশে একটা টেবিল, পাশে সাইডবোর্ড, একটা আলমারি, কফি-টেবিল, দুটি আর্মচেয়ার। ওহ্, আসল কথাটাই প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। টেলিভিশন! ওটাকে কোথায় রাখলে ভালো দেখাবে? মমম…এ নিয়ে বরং পরে ভাবা যাবে। আর কী? চওড়া দেখে একটা ডিভান, ভ্লাদিমির আর ল্যুবাদের বাসায় যেমন, ঘরের এক কোনায় থাকবে ফ্লোর ল্যাম্প, দেয়ালে হেমিংওয়ের প্রতিকৃতি। এই তো!
বিয়েতে কাকে কাকে নিমন্ত্রণ জানানো যায়? আমার আত্মীয়রা থাকে অর্ধেক শহরজুড়ে। ওর আত্মীয়ের সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও বেশি। সে ক্ষেত্রে বিয়ের উৎসব হবে আত্মীয়দের বাদ দিয়েই। থাকবে শুধু বন্ধুরা। হিসাব করি…সর্বনাশ! ইতিমধ্যেই ৪০ জন! বুঝেছি, ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ নয়, এখানে প্রয়োগ করতে হবে কৃত্রিম নির্বাচন-পদ্ধতি। সাশাকে ডাকব না; ও ‘ডায়নামো’ দলের সমর্থক। বাদ লেনা আর লিদাও, বড্ড বেশি খায় ওরা। গ্রিগোরিয়েভকে ডাকলে সে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে উৎসবটাকেই মাটি করে দেবে, অতএব সেও বাতিল। নভজাভেতস্কি-দম্পতিকে দাওয়াত দিলে তারা অবধারিতভাবে তাদের বিচ্ছু বাচ্চাটাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবে এবং সে আবার টেবিলের তলায় ঢুকে অতিথিদের প্যান্টে আগুন ধরিয়ে দেবে। সুতরাং এই পরিবার থাকবে নিমন্ত্রণবহির্ভূত। আর তা ছাড়া আমন্ত্রিত সবাই যে আসবে, তা তো নয়। অতএব সমস্যা হবে না আশা করি।
এরপর শুরু হবে দৈনন্দিন দাম্পত্য জীবন। সন্ধ্যাবেলা টিভি দেখব একসঙ্গে বসে। শনিবারগুলোয় সিনেমা দেখতে যাব। আর রোববারগুলো বরাদ্দ থাকবে ওকে নিয়ে আমার মায়ের বাসায় যাওয়ার জন্য। মা নিশ্চয়ই বেজায় খুশি হবেন। কিছুদিন ধরে একটা কথাই মা বলে চলেছেন: ‘কবে যে তুই বিয়ে করবি!’
আচ্ছা, আমাদের ছেলে হবে? নাকি মেয়ে? না, ছেলে হলেই ভালো। একসঙ্গে ফুটবল দেখতে যাব। তবে ছেলেদের নিয়ে ঝক্কি-ঝামেলাও বেশি: সিগারেট ফুঁকতে শুরু করবে, মারামারি করবে, স্কুলে নানাবিধ কাণ্ডকীর্তি করবে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা অনেক বেশি শান্ত। তবে তারা বড় হয়ে উঠলে বিয়ে দিতে হবে।…ধুর! কী সব ভাবছি। যে হওয়ার, হবে। ছেলে হলে নাম রাখব য়েভগেনি। য়েভতুশেঙ্কোর সম্মানে। আর মেয়ে হলে, য়েভদোকিয়া। আমার নারী বসের সম্মানে। আর যদি যমজ হয়? না, এমন হবে না। যদিও কে বলতে পারে আগেভাগে! এই তো সেদিন শুনলাম, মেক্সিকোয় এক নারী একসঙ্গে আট সন্তানের জন্ম দিয়েছে। অতএব যদি যমজ হয়ই, তা হলে নাম রাখব মাশা আর সাশা।
আর কী নিয়ে ভাবব? সবকিছু নিয়েই তো ভাবলাম। না, বাকি আছে আরও। এই যেমন, মেয়েটার সঙ্গে এখনো ঠিক পরিচিত নই। তবে এটা তুচ্ছ ব্যাপার। আধুনিক সভ্যতা প্রবর্তিত লৌকিকতা। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি। তার প্রথম দর্শনের হাসিটাই আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।
ভাবছি, পরিচয়টা শুরু করব কীভাবে। ‘আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারি?’ বড় বেশি সেকেলে ও বহুলব্যবহূত। সবাই এভাবেই শুরু করে। ‘আমাকে অমুক জায়গায় যেতে হলে কোথায় নামতে হবে?’ না! মনে ধরছে না। আইডিয়া! বুদ্ধি পেয়েছি! তার দিকে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করব, ‘আপনি হাসছেন কেন?’ সে চোখ নামিয়ে নেবে এবং আমি তার চোখের ভাষা থেকে জেনে যাব তার অব্যক্ত উত্তর: ‘কারণ…’
কিন্তু সে চোখ নামিয়ে নিলে তার চোখের ভাষা পড়ব আমি কী উপায়ে? তার মানে, সে চোখ তুলে তাকাবে। এবং সেটাই হবে স্বাভাবিক।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালাম নতুন জীবনের পথে।
‘আচ্ছা, আপনি হাসছেন কেন?’
এবার সে সশব্দে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘কারণ, আপনার নাকের ডগায় কালি লেগে আছে।’
পূর্ববর্তী:
« প্রথম গাড়ি প্রথম প্রার্থনা
« প্রথম গাড়ি প্রথম প্রার্থনা
পরবর্তী:
প্রথম শিক্ষা »
প্রথম শিক্ষা »
Leave a Reply