যেদিন থেকে প্রেম করতে শুরু করেছি, সেদিন থেকে শুরু করে আজ অব্দি উপহারের সমস্যা আমার পিছু ছাড়ছে না। সেই সময়ে বাজারে ঘুরতে ঘুরতে ভাবতাম, ঠিক কোন ফুল তাকে উপহার দেওয়া যায়। কিছু ফুল বেজায় দামি, বাকিগুলো ঠিক সুদর্শন নয়।
সেই থেকে যেকোনো উৎসব মানেই আমার মস্তিষ্কপীড়া। গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে ভাবি, কী উপহার দেওয়া যায় স্ত্রীকে। কিছুদিন আগে এক পত্রিকায় পড়লাম ‘পুরুষদের জন্য উপদেশ’। পড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলাম খুশিতে। নিবন্ধের লেখক ছিলেন স্রেফ জিনিয়াস। তাঁর মতে, স্ত্রীর জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার প্রশংসা। লেখকের বক্তব্য: ‘মেয়েদের কাছে প্রীতিকর বাণী সবচেয়ে মূল্যবান উপহারের চেয়েও বেশি দামি।’
অচিরেই উপহারবিষয়ক এই উপদেশ প্রয়োগ করলাম বাস্তব জীবনে।
‘জানো,’ বললাম স্ত্রীকে, ‘তোমার মুখের রংটা আজ কী যে সুন্দর লাগছে!’
সবিস্ময়ে সে আমার দিকে তাকাল, তারপর আয়নার দিকে এবং হেসে ফেলল।
পরদিন একেবারেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললাম, ‘তোমার চোখ দুটোও কী ডাগর ডাগর!’
লক্ষ করে দেখলাম, প্রশস্তিগাথা তার মনে ধরছে খুব। এমনকি আমার এও মনে হলো, তার মনটা বরাবরের চেয়ে বেশি ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। এই উপদেশরচয়িতার প্রতি আমি যে কী কৃতজ্ঞ! স্ত্রীকে তৃপ্তি দিতে পারছি, আবার অর্থব্যয়ও হচ্ছে না এর পেছনে।
তবে কিছুদিন পর উপলব্ধি হলো, একই স্তুতিবাক্য আমি বারবার ব্যবহার করছি। এই যেমন, এক সপ্তাহে তার কেশবিন্যাসের প্রশংসা করেছি দুবার এবং তিনবার প্রশংসা করেছি তার হাঁটার মোহময়ী ভঙ্গির। উপায়ান্তর না দেখে একটা নোটবুকের ব্যবস্থা করতে হলো। ওখানে লিখতে শুরু করলাম কবে এবং কী প্রসঙ্গে প্রশংসাবাক্য উপহার দিয়েছি স্ত্রীকে।
সত্যি বলতে, প্রশংসা-পদ্ধতি শুরুতে যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা সহজ নয় আসলে। কারণ-অবাস্তব নয়, আবার সত্যের সঙ্গে সুদূরতম সম্পর্কযুক্ত—এমন বাণী নিরন্তর রচনা করা কি চাট্টিখানি কথা! এই যেমন এক উৎসব উপলক্ষে আমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম আগে থেকেই:
‘তোমার ধারণাও নেই, কত অপরূপা তুমি আজ। তোমার নিজের সেলাই করা জ্যাকেট তোমাকে করেছে স্নিগ্ধতর এবং হালকা ছায়া ফেলেছে তোমার মুখে, যে মুখ সবচেয়ে প্রতিভাবান চিত্রকরের তুলিতে অঙ্কিত হওয়ার যোগ্য। আমাদের পুরো দালানে তোমার তুলনীয় কেউ নেই…’
প্রতিক্রিয়া হলো আশাতীত। আমার বাণী শোনার পর পুরো একটা ঘণ্টা সে নড়ল না আয়নার সামনে থেকে।
তার জন্মদিনে তাকে উপহার দিলাম চার পৃষ্ঠার প্রশস্তিগাথা, যেটার শেষাংশ ছিল এ রকম:
‘মেধা, সৌন্দর্য আর রুচিবোধের বিচারে তোমার তুল্য কেউ নেই এ মহল্লায়…’
স্ত্রীর সারা সন্ধ্যা কাটল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। অবশ্য কিছুদিন ধরেই সান্ধ্য অবসর সে মূলত ওখানেই কাটাচ্ছে। থিয়েটার-মুভিতে যায় না, এমনকি টিভিও তাকে সেখান থেকে সরাতে ব্যর্থ।
৮ মার্চ*—বিশেষ উৎসব, সে তো সবারই জানা। এ উপলক্ষে স্ত্রীকে অনন্যসাধারণ কিছু উপহার দেব ঠিক করেছি। সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন কাটালাম পাবলিক লাইব্রেরিতে। বিশ্বসাহিত্যের কাব্যসাগর সেচে তুলে আনা মণি-মুক্তাখচিত প্রশস্তিগাথাটি হলো অতীব চিত্তবিমোহনকারী। আমার উপহারটি দাঁড়াল প্রায় পাঁচ পৃষ্ঠার।
তাকে উপহারে ভূষিত করলাম প্রায় আধঘণ্টা ধরে। শেষে তাকে অভিহিত করলাম শহরের সবচেয়ে সুন্দরী উপাধিতে।
আলো ছড়ানো হাসি হাসল সে।
‘ঠিকই বলেছ তুমি,’ বলল সে। ‘আমি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, অনন্যা; আমি শহরের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। তা হলে আমি আমার সৌন্দর্য কেন নষ্ট করব তোমার মতো গবেটের সঙ্গে থেকে? আমি ভালো করে ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। আমার মেধা ও গুণ নিয়ে আমি তোমার চেয়ে শ্রেয় কাউকে পাওয়ার অধিকার রাখি…’
এবং ভাবতে পারেন, সে চলে গেল! আমি বসে বসে ভাবছি, যে কথাগুলো আমি তাকে বলেছি, সে কি সত্যিই সেসব বিশ্বাস করেছে?
* বিশ্ব নারী দিবস। এই দিনটি সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলোয় খুব ঘটা করে পালিত হয়।
Leave a Reply