ফোন বেজে উঠল আবার। আমি রিসিভার হাতে নিলাম। এক শিশুকণ্ঠ প্রশ্ন করল আদুরে স্বরে, ‘যন্ত্র ভায়া, ও যন্ত্র ভায়া, আবহাওয়া কেমন থাকবে আগামীকাল, বলো না!’
‘কোথায় ফোন করেছ তুমি?’ ভদ্রতা বজায় রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম।
‘যন্ত্র ভায়ার কাছে, যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানায় টেলিফোনে।’
‘বালিকা, তুমি ভুল করেছ। এটা ফ্ল্যাট!’ বললাম প্রায় চিৎকার করে। ধৈর্য ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না।
‘তুমিও ভুল করেছ। আমি বালিকা নই, বালক। তাই বলে আমি কিন্তু চিৎকার করছি না।’
এক মিনিট পর আবার এল তার ফোন।
‘কত নম্বরে ডায়াল করেছ?’ আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রয়াস সচল করলাম আবার।
‘৪৩-০৭-১২।’
‘এটা আমার বাসার নম্বর।’
‘না!’
‘কে সঠিক জানে? এত বেশি আত্মবিশ্বাসী হলে চলে না, বালক!’
সদ্য প্রকাশিত টেলিফোন গাইডটা হাতে নিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ! একেবারে প্রথম পাতায়ই বড় বড় অক্ষরে লেখা: ‘স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যুরো-৪৩-০৭-১২।’ তবে শেষ পৃষ্ঠায় খুদে হরফে আরও কিছু মুদ্রণপ্রমাদের তালিকায় লেখা আছে: ‘আবহাওয়া পূর্বাভাস ব্যুরোর প্রকৃত নাম্বার-৩৩-০৭-১২।’
মাঝরাতে উপর্যুপরি এক টেলিফোন কলের পর আমি হিসাব কষে দেখলাম, আমাদের ১০ লাখ মানুষের এই শহরের প্রত্যেককে ভয়াবহ মুদ্রণপ্রমাদটার কথা পৌঁছে দিতে আমার সময় লাগবে প্রায় ১৮ বছর।
সকাল আটটায় আরেকটা মহান আবিষ্কার করলাম আমি: সবাইকে ভুলটা জানানোর চেয়ে অনেক বেশি সহজ ও দ্রুত…আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানো! একটা টেক্সটও দাঁড় করিয়ে ফেললাম: ‘আংশিক মেঘলা, কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা, তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি।’ পুরোটা পড়তে সময় লাগছে ঠিক চার সেকেন্ড। জানি, এমন তথ্য বিভ্রান্ত করবে লোকজনকে, ভুল ধারণা দেবে। তবে সেটা আবহাওয়া দপ্তরের সঙ্গে আমার সাযুজ্যও বাড়াবে।
সন্ধ্যাবেলা কয়েকজন অতিথি এল আমার বাসায়। মিনিট খানেক পার না হতেই টেলিফোন বেজে উঠল।
‘আংশিক মেঘলা, কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা, তাপমাত্রা…।’
অতিথিরা হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। ঘটনাটা তাদের বোঝাতে যাব, কিন্তু তখনই আবার টেলিফোনের রিং।
‘আংশিক মেঘলা, কোথাও কোথাও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা, তাপমাত্রা…।’
উদ্বিগ্ন অতিথিরা আমাকে সরিয়ে আনল টেলিফোনের কাছ থেকে। অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াল জোর করে। ডেকে আনল আমার চাচিকে, যাতে তিনি সারা রাত পাহারা দেন আমার পাশে বসে।
পরদিন সকালে টেলিফোন গাইডের সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করলাম। শান্ত, ধীরস্থির মানুষ।
‘বুঝলেন, টেলিফোন গাইড—এটা আমাদের দপ্তরের কর্মীমণ্ডলীর বিরাট সাফল্যের ফসল। আমি নিশ্চিত, অনেক পাঠকের কাছে তা ডেস্কবুকে পরিণত হবে। হ্যাঁ, কিছু মুদ্রণপ্রমাদ তাতে আছে বটে, তবে সেগুলো ‘আবহাওয়া তৈরি করবে না*।’
‘আবহাওয়া তৈরি করবে না মানে!’ প্রায় চিৎকার করে বললাম আমি। ‘ঠিক আবহাওয়াই তৈরি করছে ওগুলো।’
বাসায় ফিরলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। টেলিফোন বাজছে আরও ঘন ঘন। এর কারণ, খুব সম্ভব, আমি গতকাল ঝড়ে বক মেরে সঠিক পূর্বাভাস দিতে পেরেছিলাম।
হঠাৎ মজা পেতে শুরু করলাম পুরো ব্যাপারটা থেকে। পূর্বাভাস দিতে থাকলাম কবিতা আর গানের মাধ্যমে।
রিং—‘আমাদের শহরে এসেছে বৃষ্টি, চলছে দিবস-রজনীজুড়ে…’
রিং—‘হে তুষার, তুষারকণা, কীভাবে তুমি উঠছ নেচে তুষারঝড়ে…।’
রিং—‘বায়ু বয় এ বিশ্বজুড়ে…।’
রিং—‘ঝড়ের গর্জন, বৃষ্টির কঙ্কণ…।’
যখন অ্যাম্বুলেন্স এল, আমি তখন টেলিফোনে শোনাচ্ছিলাম বাচ্চাদের ছড়া: ‘বৃষ্টি হয়তো হবে, হয়তো বা ঝড় > শোনো সব ছেলেমেয়ে, ছেড়ো নাকো ঘর…।’
‘হুমম,’ আমাকে মন দিয়ে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ‘নার্ভাস সিস্টেমে সমস্যা। বিশ্রাম প্রয়োজন। আর প্রয়োজন নিয়মিত খাওয়াদাওয়া। পার্কে হাঁটাচলা করবেন, ঘুরতে যাবেন বনে এবং অতি অবশ্য ভালো আবহাওয়ায়।’
তারপর আঙুলের ইশারায় আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘ধরুন, শহরের বাইরে কোনো বনে বেড়াতে যাবেন। তার আগে ৪৩-০৭-১২ নম্বরে ফোন করে আবহাওয়ার পূর্বাভাস জেনে নেবেন। সাম্প্রতিককালে তাদের অনুমান সঠিক হচ্ছে এবং জানেন, পূর্বাভাস শুনতে পাবেন কবিতায়! কী দারুণ ব্যাপার! আমি নিজে দিনে বার তিনেক ফোন করি!’
* রুশ ভাষায় ‘আবহাওয়া তৈরি করা’র রূপক অর্থ প্রভাব ফেলা।
সংকলন ও অনুবাদ: মাসুদ মাহমুদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৯, ২০১২
Leave a Reply