‘চুম্বন একটি অসমাপ্ত আয়োজন। অথচ এখান থেকেই শুরু হতে পারে সমুদ্র-ভ্রমণ।’ কেননা ‘প্রতিটি মানুষ নিজেরই অজান্তে ভেতরে বহন করে সমুদ্র।’ একাকী অবলোকনের নির্জন গুহায় এসে জগৎকে এক পিপাসাপুস্তক-রূপে পাঠ করতে চান অনন্ত সুজন। নিদাঘ-নিহত এই নগরে বারবার তিনি উচ্চারণ করেন সমুদ্র আর নাবিকের কথা। ‘সমুদ্র ভেবে নেমেছি বিষাদে, হতে পারে এ এক আনন্দভ্রমণ’—এ কথা বলার আগেই কবি কিন্তু আমাদের জানিয়েছেন, ‘আমার শুধু বর্ষসেরা হাহাকার আছে। পূর্বাপর আমি যা ভেবেছি বর্ষিত হয়েছে তা উল্টোমন্ত্রে।’ প্রকৃতপক্ষে, এই মন্ত্রেই তাঁর সিদ্ধি, যা তাঁকে ঠেলে দিয়েছে এমন উদ্ঘাটনে, ‘আর একটু এগিয়ে রক্তদাগের উপর ফুটে আছে ফুল—জগদভ্রম।’ সেখানে পৌঁছাতে গেলে, তাঁর ভাষায়, পার হতে হবে ‘দূরত্বদাহ’। কবির গভীরতর প্রতীতি, সেটি সম্ভব। কারণ, ‘ছায়া যদি ছায়ার ভেতর হারাতে চায় দূরত্ব, কতকাল শাসন করবে মনোভূমি?’
কবিতার পঙিক্ত ধরে আরেকটু এগিয়ে গেলে আমরা মুখোমুখি হব কালের বিপরীতে প্রতিকালের—তখনই হয়তো সম্ভব হবে মুহূর্তভেদের, ‘এখন উদ্গীরিত অসময়—ব্যর্থদিনে স্মৃতিযান এসে/নামিয়ে দিয়ে যায় লবণপাহাড়। তার অসমাপ্ত/চূড়া থেকে নেমে আসে বজ্রনখ। ধীরে, যুগের/সঞ্চারণ নিয়ে ক্ষতসভ্যতার উপর তাঁবুর ভেতর যত উদ্যাপন।’ সুন্দর ও ভয়ংকরের স্কেচ আঁকেন কবি প্রায় একই পটে। নারীর ‘টিপ’ দেখে যেমন তাঁর রক্তমুগ্ধ বৃত্তের কথা মনে আসে; যাকে তিনি প্রতিদিন দেখেন স্বাধীন স্বদেশের পতাকায়—ঠিক সেই পটভূমিতেই তার আবিষ্কার, ‘প্রতিটি স্বাধীন গৃহ এক একটি স্বতন্ত্র কারাবাস।’ নিমেষে এই পটচিত্র পাল্টে হয়ে দাঁড়ায় আতঙ্কভূমি—অকস্মাৎ বজ্রপাতে নিহত যুবকের কবরের পাশে লাশ চুরির ভয়ে নিদ্রাহারা মা ও বোন যেখানে ফেলেছে পাহারা।
এই দৃশ্যপট থেকে খানিকটা সরে এসে যখন কবি নীরবতাকে মদের মতো পান করেন, তখন স্বভাবতই তাঁর ভেতর থেকে ভারী গর্জন ভেসে আসে। অর্থাৎ বাণী মঞ্জুরিত হয় বুকের ভেতর। এখানে আমরা বিচার করব, জগতের রূপ কীভাবে তিনি ন্যাস করেন কবিতায়। ভাস্কর্য—যেমন ভাব কেটে কেটে অবয়বে নিয়ে আসা, কবিতা তেমনি—অবয়ব ভেঙেচুরে ভাবের দিকে চলে যাওয়া। এখানে এক অর্থে অ্যাপোলোনীয় ও ডিওনিসিও দ্বৈতাদ্বৈত ভাব বিদ্যমান। অন্যভাবে বললে, উপরিতল ও গভীরতলের দ্বন্দ্ব। শব্দ যদি হয় বস্তুপুঞ্জের সাড়া, যদি তার অর্থ হয় ‘আছি’, তবে নৈঃশব্দ্যের যে নিহিতার্থ ‘নাই’—তার দিকে সরে যাওয়া কবিতার দায়। তাই ভাষা যা প্রকাশ করে, তার অধিক যে অপ্রকাশ, এরই জন্য সুরের অশ্রুত কান্না। কবি অনন্ত সুজনের কাব্যচেতনায়ও তাঁর সায় আছে, ‘শব্দের সেলাই খুলে যায়/যেন পৃথিবীতে কোনো কথা ছিল না কখনো।’ কিংবা ‘প্রতিনিয়ত যা দ্যাখো/নিজেরই বাকযন্ত্রের কাছে/বিকল পড়ে থাকা/কোনো এক ব্যর্থ কোলাহল।’
কিন্তু আমাদের দৈনন্দিনতা, গৃহস্থালি, জীবনযাপনের অকিঞ্চিৎকরতা—এসবের ছোঁয়াচ পেরিয়ে কবিতা যে একটি শাশ্বত, সুদূর ও অসীম ভাবকল্পের দিকে এগিয়ে গিয়ে পাঠককে এক ধরনের প্রসৃতি ও প্রশান্তি দিতে চায় কিংবা চায় বিস্ময় ও বিমূঢ়তার দিকে ঠেলে দিতে, সেই পথে কবি অনন্ত সুজন কখনো বা নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। একটা উদাহরণ দিই। ‘শুক্রবার’ কবিতার শেষাংশে এসে কবি বলছেন, ‘আধখানা চাঁদ জেগেছে তার বাকিটা বুঝি প্রকাশের তাড়নায়।’ এরপর এই বাক্য কিছুতেই আসতে পারে না, ‘ঈশ্বর, বেকার ব্যাধি সরে গেলে আমার নবুয়্যতে দিও/বিনে পয়সায় ওড়না প্রদানের ক্ষমতা।’ এটা যেন অনেক উঁচুতে উড়িয়ে ঘুড়ি ফের টেনে নামানো। ‘মেয়েটিকে নিয়ে’ কবিতায় আমরা দেখব, এটা শুরুই হয়েছে অনুভবের তুঙ্গদশা থেকে, ‘জানালার ওপাশে কত সে দৃশ্যময়/ পাতার আড়ালে যেন ফলের আবেগ।’ অথচ শেষ হয়েছে এই আবেগকে ডাইলুট করে দিয়ে—‘যারে একদিন না দেখলে/দুদিন আয়ু কমে যায়।’ যদিও কবির উপলব্ধি ‘জলজ ছলে বাষ্প হয়ে যাওয়ার’ বিভ্রমকে শনাক্ত করেছিল। কিন্তু যে র্যাশনালিটির ফলে সম্ভব হয় না নতুন অভিজ্ঞতাকে আলিঙ্গন করা, তারও কথা জানিয়ে দেন তিনি: ‘মদ প্রতিনিয়ত আমার ভেতর হুলি খেলে/তবুও হাতের পাঁচ আঙুলকে কখনো ভাবিনি দশ।’ তাই আজ শুধু অপেক্ষায় বসে থাকা। এই ঋতু অপেক্ষার ঋতু।
এমন দু-একটি সমস্যার কথা বাদ দিলে পিপাসাপুস্তক শেষ পর্যন্ত প্রথম দশকেরই প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম দশক বা শূন্যের দশকের প্রবণতা বলতে আপাতত এই ছোট পরিসরে শুধু ইর্যাশনালিটির কথাই বলব। যেখানে পৌঁছে কবির পক্ষে সহজেই, অনেকটা আনমনেই বলে ফেলা সম্ভব, ‘ক্রন্দন বেতারবার্তার মতো লাল।’ প্রশ্ন হতে পারে, বেতারবার্তা লাল হয় কী করে? যদি লাল হয়ও বা, তার সঙ্গে ক্রন্দনের কী সম্পর্ক? ক্রন্দনের আবার বর্ণ আছে নাকি…ইত্যাদি। এসব প্রশ্নকোলাহল উপেক্ষা করে কবির অনুধাবন ঠিকই পৌঁছায় আপন গুহাতীর্থে, নিরাকার। যেখান থেকে তিনি বার্তা পাঠান, ‘কিছু অনুভব থেকে যায় না-বলা জটিল/গণিকার গোপন সুন্দরের মতো বেদনা অপার।’ যেখানে গিয়ে খোঁপা খোলার শব্দটিও শুনতে পান তিনি। এমনকি, আমরা জানতে পারি, তাঁর ঘুম ভেঙে যায় সেই খোঁপা খোলার শব্দে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply