বান্ধাল কাহিনিই বটে—ঘটনাবহুল জমজমাট কাহিনি; কিন্তু মোটেই নিরীহ গল্পগাঁথা নয়। বরং উপন্যাসটি জন-ইতিহাসের গুরুতর কিছু রূপ ও রূপান্তরকে চিহ্নিত করার সুস্পষ্ট প্রকল্প। তারেক খান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ভূভাগ আর জনজীবনকে বলিষ্ঠ হাতে তুলে এনেছেন তাঁর বান্ধাল নামের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পে। বড় আকার এ উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের বাইরের দিক—সবটুকু নয়; অন্তরের প্রযত্নেও উপন্যাসটি যথেষ্ট পরিমাণে ধনী। সেই প্রযত্নের সঙ্গী হয়েছে মানুষের প্রাত্যহিকতা ও সমগ্রতাকে একসূত্রে বাঁধতে পারার সাফল্য।
লেখক কথা বলেছেন গল্পের ছলে—তাতে আড়ালের বাড়াবাড়িতে বলার কথাটা যেন গায়েব না হয়ে যায়, সে ব্যাপারে হুঁশিয়ার থেকে। পাশাপাশি দুই অঞ্চলের দুই পরিবার উপন্যাসটির ধারা, দ্বন্দ্ব ও গতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই বাছাই বেশ কাজের হয়েছে। ওই অঞ্চলের উৎপাদনসম্পর্ক ও ক্ষমতাবলয়ের ধরন-ধারণ এ দুই পরিবারে কেন্দ্রীভূত করা গেছে। অবশ্য এদের প্রতাপে আশপাশটা পুরোপুরি ঢেকে যায়নি। বরং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নতুন নতুন পক্ষগুলো যুক্ত হয়ে জীবনধারার গতি ও পরিবর্তনশীলতাকে নিশ্চিত করেছে। এই দ্বন্দ্ব উৎপাদনব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গ্রামসমাজে অভিজাত হয়ে ওঠার তৎপরতাও বটে। এসব দ্বন্দ্ব, বিকাশ বা পতন সম্ভাব্য সর্বাধিক বিস্তৃতি ও অন্তরঙ্গতায় চিহ্নিত করেছেন লেখক। কিন্তু কোথাও নিজের পরম লক্ষ্যটির কথা বিস্মৃত হননি। অর্থাৎ উপন্যাসটির প্রধান দুটি তল—সমগ্রের লক্ষ্যমুখিনতা আর অংশের ডিটেইলস—বেশ সাফল্যের সঙ্গে পরস্পরকে অনুসরণ করেছে।
পুরো উপন্যাসে পাওয়া যাবে এ রকম বহু উপাদেয় নমুনা। আমি এখানে একটি মাত্র উদাহরণ দিচ্ছি। শুরুর দিকে—দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে—আমরা একটি চরিত্রকে বজরাযোগে নদীর মাঝ বরাবর এগোতে দেখি। এখানে নদীর বর্ণনা আছে, গাছগাছড়া-পাখপাখালি আর পানির বর্ণাঢ্য স্বচ্ছলতার পরিচয় আছে। আছে বজরাযোগে চলার আনন্দ। একটু বেশিই আছে। কাহিনির গতির সঙ্গে এ বর্ণনা বিযুক্ত নয়। এই চরিত্রটির সঙ্গে পাঠকের চিনপরিচয় ঘটানোর দায়িত্বও অংশটি পালন করে। আর বর্ণনার সৌন্দর্য ও সক্ষমতা তো আছেই। তবুও প্রথম পাঠে অংশটিকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বিস্তৃত বলেই মনে হয়। কিন্তু উপন্যাসের শেষাংশে বর্ণাঢ্যতা ও কেজোরূপ-হারানো নদীটিকে একটা মৃত জীর্ণ অজগরের মতো শুয়ে থাকতে দেখে পুরানা কালের ওই সৌন্দর্য বৈপরীত্যের প্রচণ্ডতায় আমাদের রক্তাক্ত করে। শুধু মরা নদীর বর্ণনায় এই ইফেক্ট কিছুতেই পাওয়া যেত না।
এ উপন্যাসের অসংখ্য মানুষ ব্যক্তিগতভাবেই বাঁচে বা মরে, কিন্তু সামষ্টিক জীবনের নানা জটিল কায়কারবার থেকে তারা মোটেই বিচ্ছিন্ন নয়। ব্যাপক আয়োজন সেই সামষ্টিক জীবনের। উৎপাদনব্যবস্থা থেকে সামাজিক উৎসব, ক্ষমতাসম্পর্ক থেকে পারিবারিক টানাপোড়েন, বর্ণাঢ্য বেঁচে থাকা ও সর্বগ্রাসী মৃত্যু পর্যন্ত তার বিস্তার। ওই অঞ্চলের জনজীবনে তারেক খানের অভিজ্ঞতা ঈর্ষণীয়। সেই অভিজ্ঞতাকে উপন্যাসের ছাঁচে ভালোভাবেই ব্যবহার করছেন তিনি। প্রচলিত পদ্ধতি মেনে দিয়েছেন চরিত্রানুগ সংলাপ ও আঞ্চলিক ভাষা। আর বর্ণনার ভাষার ক্ষেত্রে এগিয়েছেন আরো অনেকখানি—আঞ্চলিক নামশব্দ ও ক্রিয়াপদ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন বিশেষ অঞ্চলের গভীর বাস্তব। একই সঙ্গে হুঁশিয়ার থেকেছেন মধ্যবিত্ত পাঠকের পাঠ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যাপারেও, যেন অতিরিক্ত অপরিচিত শব্দ খুব বড় বাধা হয়ে না ওঠে।
তবে এসবই এ রচনার বহিরঙ্গ মাত্র। আমার কাছে আকর্ষণীয় লেগেছে তারেক খানের প্রকল্প। নদীমাতৃক বাংলার নদীনির্ভর জনজীবনের সে এক বিপুল-গভীর-দরকারি ইতিবৃত্ত। তার একদিকে আছে পানিপ্রবাহের সঙ্গে জীবনের নিত্য ও নৈমিত্তিক সম্পর্কের গাঁথা; অন্যদিকে মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক নানা কারণে সেই প্রাণপ্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে এক বিরাট জীবনচক্র কী করুণ আর মর্মান্তিক পরিণতির শিকার হয় তার বাস্তবানুগ বয়ান।
নদীবর্তী বাংলার আশ্চর্য এক সমগ্রতা আছে এ উপন্যাসে। উৎপাদন ও বণ্টনের, কর্ম ও অবসরের, উল্লাস ও বেদনার সূক্ষ্ম বহু অনুপুঙ্খ নদী আর পানিপ্রবাহের সঙ্গে একাকার হয়ে তৈরি করেছে সেই সমগ্রতা। শুধু মানুষ নয়—কীটপতঙ্গ, উদ্ভিদ-ঘাস-লতা, পাখপাখালি—সবই প্রায় জৈবিক ঐক্যে শামিল হয়েছে তাতে। এ কারণেই বাঁধ—যে শব্দের আঞ্চলিক প্রতিশব্দ ‘বান্ধাল’ থেকে উপন্যাসটির নামকরণ—ও অপরাপর কারণে পানিপ্রবাহ নষ্ট হয়ে গেলে যে বিপর্যয় দেখা দেয়, তার প্রতিফলনও ঘটে সর্বত্র। তারেক খানের বর্ণনায় পাই ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মর্মবিদারী ব্যাপকতা। নদীর মরণ, প্রকৃতির বিরূপতা, কৃষিসহ সমস্ত জলজ উৎপাদনের ক্ষয়, ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদি মিলে এক বর্ণাঢ্য জনজীবনের ধ্বংসবার্তা এঁকেছেন তারেক খান।
উপন্যাসটির আকার সম্ভবত আরও ছোট করে আনা যেত। কয়েকটি খণ্ডে বিভক্ত করলে হয়তো কিছু বর্ণনা এড়ানো যেত, যেগুলো করতে হয়েছে সময়ের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে। আবেগ আর সহানুভূতির প্রাবল্য কিছু অতিরিক্ত নাটকীয়তার আমদানি করেছে। ঢাকা শহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত অংশটা এখানকার জীবনের যে সহজ-সরল ছবি হাজির করে, বাস্তবে তো সেরকম দেখি না।
এ রকম আরও কোনো কোনো ব্যাপারে বোধ হয় আপত্তির অবকাশ আছে। তাঁর সাফল্যের মাত্রাও নিশ্চয়ই বহু পাঠকের সম্মতিতে স্থির হবে। কিন্তু উপন্যাসটি পাঠ করে বলতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছি: বাস্তব সমস্যার কাছাকাছি থেকে এ ধরনের দরকারি প্রকল্প নিয়ে এত ব্যাপক কাজ বাংলাদেশের উপন্যাসে খুব সুলভ নয়।
আলগা ভাষণে নয়, কাহিনির স্বাভাবিক পরম্পরার মধ্যেই তারেক তাঁর প্রকল্পকে সম্ভবপর করেছেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply