অতীত আসলে কী জিনিস? বর্তমানের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কেমন? যে বর্তমানে আমরা বাঁচি, সেই বর্তমান কি অতীতকেও বাঁচিয়ে তোলে? আর সেই বেঁচে ওঠা কি সঞ্চারিত হয় ভবিষ্যতের ভেতরেও? প্রশ্নগুলো ইতিহাস-ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। একরৈখিক সময়ের বিশ্বাস অতীতকে গণ্য করে মৃত বলে। বহুকাল থেকে ভারতবর্ষীয় মানুষের সংশ্লেষী মন সময়সম্পর্কিত যে বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে, তা বৃত্তীয়। এই বৃত্ত কোনো কিছুকে না হারিয়ে তার চৌহদ্দিকে বিস্তৃত করে। অতীত এখানে মরে না। এ অঞ্চলে বৈদিক বা প্রাক-বৈদিক আমলের বিশ্বাসধারা ও সাধনচর্চাও কোনো কোনো মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আজও টিকে আছে বা আত্তীকৃত হয়ে আছে অন্য বিশ্বাসধারাগুলোর ভেতরে। প্রাগার্য সিন্ধু সভ্যতায় যে মাতৃকাপূজার আবির্ভাব, আজকের চৈত্রসংক্রান্তির কোনো অনুষ্ঠান-মঞ্চে যখন মুখোশ আর যুদ্ধসাজ পরে কেউ কালীনৃত্য করে, তখন একভাবে তারই কি পুনরাবির্ভাব ঘটে না? কিংবা একই সেই মাতৃভাবের পুনঃসৃষ্টি কি হয় না মাতৃতীর্থগুলোতে জড়ো হওয়া ভক্তদের মনে? এই ‘বর্তমান’-এর মঞ্চেই একজন বাউলকে আমরা দাঁড়াতে দেখি প্রাচীন বৌদ্ধ কি বৈষ্ণব সহজিয়াদের উপলব্ধ সত্য নিয়ে। আমরা কখনো হারাতে দেখি না রাধা বা কৃষ্ণকে, হারায় না রামায়ণ কিংবা মহাভারতও। একই ‘বর্তমান’-এর মঞ্চে এসে দাঁড়ান নাথসিদ্ধাদের উত্তরপুরুষগণ কিংবা কান্দনি বিষহরির গান নিয়ে কোনো ভক্ত গায়ক। মৃত্যু বা বিলোপ নয়, পুনরাবির্ভাবই সত্য এখানে। একদিক থেকে অতীত আর অন্যদিক থেকে ভবিষ্যৎ এসে বিঁধে আছে বর্তমানের শরীরে।
বাংলা সাহিত্যের লিখিত ইতিহাসে যে সাহিত্যবস্তুকে আমরা পাই, তার অনেক কিছুই আগে থেকে জনসংস্কৃতির ভেতর পরিবেশনাশিল্পের নানা আঙ্গিকে বিদ্যমান ছিল, লিখিত হওয়ার পরও থেকেছে, হয়তো কালপ্রবাহে রূপ বদলে গেছে কিংবা বিষয়ান্তর ঘটেছে। প্রশ্ন হলো, লিখিত সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যবস্তুগুলোর পরিবেশনারীতির উপস্থাপনাকে অঙ্গীকৃত করা হবে কি না। নাকি তার একটি আলাদা ইতিহাস লেখা হবে—নৃত্য, সংগীত বা সমাজ ও রাজনীতির যেমন আলাদা ইতিহাস লেখা হয়ে থাকে। গ্রন্থটির লেখক সাইমন জাকারিয়া ও নাজমীন মর্তুজা প্রস্তাব করেছেন, সাহিত্যবস্তুর পরিবেশনারীতিটাও সাহিত্যের লিখিত ইতিহাসে থাকা বাঞ্ছনীয়। যাঁরা ইতিপূর্বে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন, তাঁরা ইশারা করলেও বিস্তারিতভাবে এই দিকটিকে ইতিহাসের অন্তর্গত করেননি। লেখকেরা এই শূন্যতাকে আবিষ্কার করে তা ভরাট করার ব্রত নিয়েছেন।
গ্রন্থের লেখকদ্বয় তাঁদের এই কাজকে ‘বাংলা ভাষার লিখিত সাহিত্যের একটি জনসাংস্কৃতিক জরিপ উপস্থাপনা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তাঁরা বৌদ্ধ সহজিয়াদের রচিত চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের কিছু তৎকালীন পরিবেশনারীতির অনুসন্ধান ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে জরিপকাজটি করেছেন, তা হাল-আমলের। কাজেই যৌক্তিকভাবে যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, সাম্প্রতিকতম সাহিত্য-ঘটনাকে ইতিহাস গণ্য করা হবে কি না। তবে এই প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়েও আমরা বলতে পারি, বাংলা সাহিত্যের নানান ধারা—কি রামায়ণ-মহাভারত, কি মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, নাথ বা ইসলামি সাহিত্য—এসবের যে জীবন্ত সত্তা মানুষের পরিবেশনারীতির ভেতর মূর্ত হয়, লেখকেরা সশরীরে গিয়ে তার তালাশ করেছেন, ‘অলিখিত ইতিহাস’ শিরোনামের বাইরেও এসবের স্বতঃমূল্য রয়েছে।
লেখকেরা যাকে জনসাংস্কৃতিক জরিপ বলে দাবি করছেন, সেই জরিপের কাজটিতে পরিবেশনারীতিগুলোর বিবর্তনের ধারাকে চিহ্নিত করা না গেলে কাজটি অসম্পূর্ণ এবং খণ্ডিত থেকে যায়। আর ক্ষেত্রটি যখন জনসাংস্কৃতিক, তখন কেবল পরিবেশনারীতির উপস্থাপনা দিয়ে তা পূর্ণতা পেতে পারে না। এতে যে জিজ্ঞাসাগুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, তা হলো—জনসংস্কৃতির সঙ্গে সাহিত্যবস্তুগুলোর সম্পর্কের ধরনগুলো ঠিক কী কী ভাবে নির্ধারিত হচ্ছে; ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলোর ধর্মবোধ, শ্রেণীবিরোধ ও লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে কীভাবে সাহিত্যের উপাদানগুলোর শরীর গড়ে উঠছে, রূপ বদলাচ্ছে আঙ্গিক বা বিষয়ের। সুনির্দিষ্ট করে দু-একটি প্রশ্ন তুলে দেখানো যায়, যেমন—চৈতন্যযুগের বাঙালি সংস্কৃতিতে কেন এবং কীভাবে নতুন রূপ নিয়ে কৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটল, অশাস্ত্রীয় এক দেবী রাধাই বা কীভাবে এত প্রভাব নিয়ে আবির্ভূত হলেন। এসব প্রশ্নকেও এড়িয়ে যাওয়া চলে না যে জনসংস্কৃতি গঠনে সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বন্ধন কীভাবে আশ্রয় করে একেকটি আখ্যান ও তার পরিবেশনাকে। কীভাবে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের ভেতরের সত্যটি বাইরে এসে তার অভিব্যক্তিকে বদলে দেয়, বদলে যায় তার আখ্যান পরিবেশনার আঙ্গিক আর বিষয়। এ ধরনের অনুসন্ধানের প্রকট অনুপস্থিতি আছে গ্রন্থটিতে। ফলে ‘লিখিত সাহিত্যের জনসাংস্কৃতিক জরিপ’-এর দাবিটি এই গ্রন্থে অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।
ইতিহাস অনুসন্ধানে অবস্থানিক বস্তুনিষ্ঠতা আর প্রখর বাস্তববোধ অত্যন্ত জরুরি। লেখকেরা যেহেতু সাহিত্যের বিশেষ একটি দিক অর্থাৎ পবিশেনারীতির খোঁজ করেছেন, এই নির্দিষ্ট অবস্থান ও অভিপ্রায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের বাস্তববোধকে অভিভূত করেছে। একটি দৃষ্টান্ত দেখানো যায় চর্যাপদের পরিবেশনারীতি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে। চর্যাপদের ভাষা দ্ব্যর্থক ও ইঙ্গিতময়—এ থেকে আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ ভুল সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সহজিয়া বৌদ্ধদের বিশ্বাস ও সাধনধারা থেকে চর্যাগুলোর সরলার্থ করা হয়ে থাকে। প্রায় প্রতিটি চর্যাতেই এমন একটি ভ্রমণের নির্দেশ লক্ষ করা যায়, কীভাবে সাধক প্রাতিভাসিক অবস্থা থেকে পারমার্থিক অবস্থায় যাবেন, ভেদের জগৎ থেকে অভেদে পৌঁছাবেন। আত্মপর ভেদ নেই এমন একটি অদ্বৈত অবস্থাকে চর্যাগুলোতে নানা রকম উপমা দিয়ে বোঝানো হয়েছে, কোথাও বলা হচ্ছে হরিণের ক্ষুর দেখা যাচ্ছে না, কোথাও আছে বোবাকে দিয়ে সম্বোধন করানো হচ্ছে কালাকে, একই সহজাবস্থাকে বোঝাতে কোথাও বলা হচ্ছে ভাব নেই, অভাবও নেই; তেমনি একটি রূপকল্প হলো নির্বাণনাট্যে যার নাচবার কথা সে গাইছে আর যার গাইবার কথা সে নৃত্য করছে—এ থেকে বুদ্ধনাটকের অস্তিত্ব হয়তো অনুমান করা যায়, কিন্তু পরিবেশনারীতি খুঁজে পাওয়া দুরূহ। মহাযান বৌদ্ধমতের বজ্রযানী সম্প্রদায়ের মধ্যে তন্ত্রমন্ত্র, যোগ-মুদ্রা, ডাকিনী-আবাহন ইত্যাদি সমেত আড়ম্বরপূর্ণ সাধন পদ্ধতির প্রচলন ছিল। এমনিতে যোগ ও কায়াসাধনা বৌদ্ধমতের প্রায় সব শাখাতেই ছিল, ফলে টেরাকোটা বা রেখাচিত্র থেকে নাট্যিক উপাদান পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। এ ছাড়া সিদ্ধাচার্যদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে চতুরশীতি-সিদ্ধ-প্রবৃত্তি নামের যে গ্রন্থটিকে অবলম্বন করা হয়েছে, সেটিও অলৌকিক কর্মকাণ্ডে ভরা—এসব থেকে সত্যকে একটা মাত্রা পর্যন্ত অনুমান করা যায়, কিন্তু লেখকেরা যে ‘সম্যক ধারণা’ পেয়েছেন, তাকে অভিপ্রায়িক বলে মনে হয়।
গ্রন্থটিতে অনেক অসম্পূর্ণতা আছে সত্য; কিন্তু যে প্রস্তাবনাকে সামনে রেখে এর লেখকেরা বিপুল এক অনুসন্ধানযজ্ঞে নেমেছেন তার পেছনের চিন্তাটি কৌতূহলোদ্দীপক। তাঁরা পরিবেশনারীতি থেকে সাহিত্যের সত্তাকে খুঁজছেন, ভঙ্গি থেকে যেমন অন্বেষণ করা হয়ে থাকে আত্মাকে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply