কনফেশান বক্সের ভিতর। অটাম-দিনের গান—এই হলো উপন্যাসের নাম। অভিনব সন্দেহ নেই। কিন্তু দুই বাক্যের এই শিরোনাম যতটা চমৎকৃত করে, তার চেয়ে বেশি এমন একটা ধারণা তৈরি করে যেন এ লেখা লিখেছেন এমন কেউ, যিনি একালের সেইসব তরুণ-তরুণীর দলে, যাঁরা মাতৃভাষা বাংলায় মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যুতসই বাংলা শব্দ খুঁজে পান না। মাতৃভাষার প্রতি এমন বিরাগ বা অবহেলা আমাদের মনে প্রীতি জাগায় না।
তাই, দেখি কী লিখেছেন এই কেতাদুরস্ত লেখক—এমন একটা ভাব নিয়ে পড়তে শুরু করি বইটি; এবং অবাক হয়ে দেখি, এ-লেখা টানছে। লেখকের ভাষা সুন্দর, অনুভব কাঁচা নয়; জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে যথেষ্ট ধারণা লাভের পরই তিনি লিখতে বসেছেন কয়েকজন মানুষের স্বীকারোক্তি/জবানবন্দি, লেখকের ভাষায় কনফেশান। লিখেছেন কাহিনিকারদের বহু-ব্যবহূত বর্ণনাকৌশল এড়িয়ে; কেননা, মনে হয়, কাহিনি বলা নয়, মন উন্মোচন করা লেখকের উদ্দেশ্য।
কয়েকজন মানুষের নিজ নিজ বয়ানে লেখা এই উপন্যাস। বয়ানগুলো বিচ্ছিন্ন, কিন্তু বিবরণের ভিতর থেকে চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক আবিষ্কার করা যায়। যেহেতু এটি কোনো টানা কাহিনি নয়, তাই বয়ানগুলোর মধ্যে স্থানকালগত পরম্পরা নেই। কার বয়ানের পরে কার বয়ান আসছে, কেন আসছে—এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। স্বভাবতই চরিত্রগুলোর কারোর সঙ্গে কারো দেখা হয় না, কথাও হয় না। সেসব ঘটে গেছে আগে। সেসব কথাই তারা কিছু কিছু বলে নিজ নিজ মনে। দুয়েকজন ডায়েরিও লেখে। কখনো সে-ডায়েরির উল্লেখ পাওয়া যায় আরেক চরিত্রের বয়ানে, এবং সে-চরিত্র সেই ডায়েরি-লেখকের চরিত্র-বিশ্লেষণ করে, নিজের সঙ্গে সেগুলো মেলায়।
মুখ্যচরিত্রটি বোধ করি ঝুমু, যে পুরান ঢাকার বনেদি অভিজাত কোনো পরিবারের সন্তান, এখন প্রবাসী শিক্ষার্থী। এই মেয়েটিই যে রঞ্জু নামের এক আত্মহননকারী যুবকের সেই প্রেমিকা, যার আসল নামটি রঞ্জুর ভাইবোনদের কেউ কখনো জানতে পারেনি, কারণ রঞ্জু তার ডায়েরিতে সবসময় তার প্রেমিকাটির নাম লিখেছে ক্রতু—পাঠককে কষ্ট করে এই পরিচয় উদ্ধার করে নিতে হয়। কিন্তু এসবে বড় কোনো অসুবিধা হয় না, যেহেতু প্রচলিত ধারার কাহিনীসর্বস্ব উপন্যাস রচনা লেখকের অভিপ্রেত ছিল না বলে মনে হয়। প্রত্যেকের ‘কনফেশান’ আলাদা আলাদ করে পড়তে ভালো লাগে; কখনো কৌতুক, কখনো কৌতূহল, কখনো বিষাদ, কখনো কাব্যিক আনন্দের অনুভব জাগে।
পুরো উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় বিষয় নারীত্ব; নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা নারীর সঙ্গে পুরুষের ও সমাজ-সংসারের সম্পর্ক। ঝুমুর কথায় পরিষ্কার: সে বহুনিন্দিত পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার ঘৃণা করে; কারণ ঘৃণা করার মতো অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। নারীত্বে পৌঁছার বহু আগেই, যখন তার শরীর ‘বাঁশপাতার মতো ফুরফুরে একটা জিনিস’ তখনই তাকে পড়তে হয়েছে এক পিডোফিল হুজুরের হাতে। ঝুমু তার মাকে যখন বলে, ‘আরবি হুজুরকে আসতে মানা করে দাও’ তখন তার বাবা ধরে নিলেন তাঁর মেয়েটি আরবি না পড়ার ছুঁতো করছে। ফলে, ঝুমুর মনের সাথে তার আব্বার ‘জনমের আড়ি হয়ে গেল’। এ উপন্যাসের সবগুলো নারী চরিত্রের পুরুষ-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রায়-অভিন্ন। ফরহাত বানু ও তাঁর কন্যা ইশরাত বানু যেন অভিন্ন নারী চরিত্র। আজহারউদ্দিন ও তাঁর পুত্র রঞ্জুর নারী-সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি একই রকম। আহজারউদ্দীনের বয়ানে: ‘আঁঁচ করিতাম—স্ত্রীলোকের প্রতি এরকম জাতিগত বিদ্বেষ সে আমা হইতেই উত্তরাধিকারসূত্রে পাইয়াছিল।’
এ উপন্যাসের কুশীলবদের ভিন্ন ভিন্ন আত্মকথার মধ্য দিয়ে যে-বহুস্বর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তা হয়নি, কারণ তাঁদের স্বরের স্বাতন্ত্র্য নেই, তাদের বাচনভঙ্গি প্রায় একই রকম। একজন লেখকই যে এই চরিত্রগুলোর মুখের বয়ান রচনা করেছেন তা স্পষ্ট বোঝা যায়। আজহারউদ্দীন বা ফরহাত বানুর বয়ানে সাধু বাংলার ব্যবহারেও সে-ঐক্য ঘোঁচেনি। সব চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি যেন সেই অভিন্ন রচনাকারীর দৃষ্টিভঙ্গির ন্যায্যতা প্রতিপাদনের কাজটিই করে চলে: তারা লেখকের হাতের পুতুলমাত্র, স্বতন্ত্র-স্বাধীন একেকটি চরিত্র নয়। লেখক যে নারীর চোখে জীবন-জগৎ, বিশেষ করে পুরুষ মানুষকে দেখেন, সেই দৃষ্টির রঙে রঞ্জিত সবগুলো চরিত্রের দৃষ্টি।
লেখকের বর্ণিত নারীদৃষ্টির যথার্থতার প্রশ্ন তুলছি না, তাহলে পুরুষের দৃষ্টির যথার্থতার প্রশ্নও তুলতে হয়। একজন ঔপন্যাসিক, যিনি শিল্পী, তাঁর পরিচয় নারীর বা পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধ্বে থাকে, অন্তত এমনটাই প্রত্যাশা করা হয়। এ বইয়ের লেখকের চোখ নারীর চোখই বটে, কিন্তু সে-চোখ কেবলই পুরুষের ঊনতা দেখে না, নারীর গ্লানিও বিলক্ষণ দেখে। সেজন্যই এ-বইয়ের সবগুলো চরিত্রের নিজ নিজ বয়ানকে বলা হচ্ছে কনফেশান। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বিচারের কাজটি সমাজতাত্ত্বিক বা অন্যরা সাগ্রহে করতে পারেন, উপন্যাসের পাঠক বা বিচারকদের আগ্রহ সেদিকে কম। কী পাওয়া গেল সেটাই বিবেচ্য, লেখক কী দিতে চেয়েছিলেন বা চাননি তা অপ্রাসঙ্গিক। সেই দিক থেকে কনফেশান বক্সের ভিতর-এ যা পাওয়া গেল, তা শেষ পর্যন্ত মানুষের জীবন। এবং এই জীবনের রূপায়ন পাঠকের বিচারী চোখকে উপলব্ধির রঙ জোগায়। লেখকের শিল্পিতা, তাঁর কারিগরি মুন্সিয়ানা, ভাষা ব্যবহারে সাবলীল-সপ্রস্তুত দক্ষতা এ-লেখায় সুস্পষ্ট। না, ইনি সেইসব তরুণ-তরুণীর দলে নন, যাঁরা মাতৃভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যুতসই বাংলা শব্দ খুঁজে না পেয়ে ইংলিশে কাজ চালান। বরং বাংলা ভাষায় তাঁর সুনিপুণ দক্ষতা আছে। এবং জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও উপলব্ধির পরিপক্বতার গভীর স্বাক্ষর রয়েছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়। এ দুই মিলিয়ে তিনি একজন তৈরি লেখক। তাঁর হাতে ব্যাপ্তি ও গভীরতায় আরো বড় উপন্যাস রচিত হওয়া সম্ভব।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply