পাভল্যুক যখন তার শীর্ণ গলায় দড়ির ফাঁস ঢুকিয়ে টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সময় তার কাছে এল এক দেবদূত, বলল, ‘পাভল্যুক!’
পাভল্যুক তাকিয়ে দেখল চারপাশে। ঘর একেবারেই শূন্য। দেবদূত তো আর ফ্রিজ নয়, চোখ মেলে চাইলেই তাকে দেখা যায় না। ডান কাঁধের কাছে এক জ্যোতিশ্চক্র নজরে পড়ল তার।
‘পাভল্যুক!’ আবার ডাকল জ্যোতিশ্চক্র। ‘তুমি টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘মরতে চাই আমি,’ পাভল্যুক বলল।
‘হঠাৎ?’ জানতে চাইল দেবদূত।
‘চারপাশের সবকিছু অসহ্য লাগে,’ পাভল্যুক বুঝিয়ে বলল।
‘সবকিছুই কি?’ বিশ্বাস হলো না দেবদূতের।
‘সবকিছু,’ একটু ভেবে নিয়ে পাভল্যুক জানাল নিশ্চিতভাবে। তারপর হাত দিয়ে দড়ির প্যাঁচটা টাইট করতে শুরু করল।
‘কয়েক পেগ ভদকা? প্রকৃতির মাঝে বসে?’ বলল দেবদূত।
পাভল্যুক চিন্তাচ্ছন্ন হলো, কিন্তু হাত সরাল না দড়ি থেকে।
‘সঙ্গে যদি খাদ্য হিসেবে আলু থাকে, তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে,’ জানাল সে অবশেষে।
‘ঠিক, আলুটা মাখন আর ডিল*-সহযোগে, সঙ্গে হেরিং মাছ, চাকা চাকা করে কাটা পেঁয়াজ…,’ দেবদূত বলল।
গলায় দড়ি প্যাঁচানো অবস্থাতেই ঢোক গিলল পাভল্যুক।
‘আর ভদকার প্রতিক্রিয়া জোরদার করতে বিয়ার?’ দেবদূত বলতে থাকল। ‘মাছ ধরতে বসে, যখন চারপাশে জ্বালাতন করার মতো কেউ নেই? সঙ্গে পছন্দের সিগারেট?’
পাভল্যুক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘আর কিছু মেয়ে? অপরূপা, দীর্ঘ পদযুগল…’ থামল না দেবদূত।
‘এসব কথা তুমি কোত্থেকে জানো!’ পাভল্যুক জিজ্ঞেস করল অবাক হয়ে।
‘উঁহু, প্রসঙ্গ পাল্টিও না,’ অনুরোধ জানাল দেবদূত। ‘আর শনিবার সকালবেলা বাথহাউসে গোসল, বুধবার সন্ধ্যাবেলা স্পার্তাক…’
‘স্পার্তাক মানে?’ পাভল্যুক ঠিক বুঝতে পারল না।
‘ফুটবল, চ্যাম্পিয়নস লিগ,’ মনে করিয়ে দিল দেবদূত।
‘জিতবে নাকি?’ পাভল্যুক প্রশ্ন করল।
‘সেমিফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছাবে,’ নিশ্চয়তা দিল দেবদূত।
‘তাই নাকি!’ পাভল্যুক বলল। মুখে হাসি ফুটে উঠল তার। ফাঁসটা তখন ঝুলছিল পাশে।
‘টুল থেকে নামো না, বাপু!’ দেবদূত প্রস্তাব দিল। ‘নয়তো মূর্তির মতো লাগছে একেবারে।’
টুল থেকে নেমে পাভল্যুক বসে পড়ল ঠিক ফাঁসের নিচেই। পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করল। আগুন বাড়িয়ে দিল দেবদূত।
‘এখন কী করব? কাজে যাব?’ পাভল্যুক প্রশ্ন করল।
‘কাজে যাবে,’ দেবদূত বলল।
‘তারপর বাসায়?’
‘সেই চেষ্টা করতে হবে।’
পাভল্যুক নীরব রইল খানিকক্ষণ, তারপর বলল, ‘আচ্ছা। কিন্তু কী লাভ?’
‘লাভ মানে?’ বুঝতে পারল না দেবদূত।
‘বেঁচে থাকার একটা কোনো অর্থ তো থাকতে হবে,’ পাভল্যুক বলল।
‘অর্থের কী প্রয়োজন?’ দেবদূত বলল প্রতিবাদের সুরে।
‘অর্থ ছাড়া সম্ভব নয় কোনোমতেই,’ বিড়বিড় করে বলল পাভল্যুক।
‘তাহলে গলায় দড়ি দাওগে, যাও,’ দেবদূত বলল। ‘বেঁচে থাকার অর্থ চাই তার! তার চেয়ে বরং মানুষের মাথা খারাপ না করে গলায় দড়ি দিয়ে মরোগে!’
* ডিল—ধনেপাতা ধাঁচের সুগন্ধি লতা।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ১৮, ২০১২
Leave a Reply