বাসায় বসে ফুটবল খেলা দেখছিলাম টিভিতে, সেই সময় স্ত্রী এসে বসল পাশ ঘেঁষে, তারপর অভিযোগের সুরে বলল, ‘একটা আদরের কথাও যদি বলতে! সেই হানিমুনের পর থেকে তেমন কিছু আর শুনিইনি।’
‘তেমন কিছু মানে?’
‘আমি সেটা কীভাবে জানব!’ লজ্জা পেয়ে স্ত্রী বলল, ‘তুমিই ভেবে বের করো।’
‘আমি তো আরও জানি না, তুমি কী শুনতে চাও। এই ধরো… ডার্লিং…’ কথাগুলো বললাম, যখন আমাদের গোলবারের সামনে বিপজ্জনক অবস্থা।
উপলব্ধি হলো, স্ত্রী তৃপ্ত হয়নি আমার কথায়।
‘আচ্ছা, তাহলে বলি… আদরের পাখিটা…’
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার মুখটা ছেয়ে গেছে বিরক্তিতে।
‘জানো, কী করা যায়?’ বললাম তাকে, ‘তুমি তো অজস্রবার আমাকে অনুরোধ করেছ আদরমাখা কথা বলতে, তো এই আদুরে কথাগুলো আমি রেকর্ড করে রাখব ক্যাসেট রেকর্ডারে। তারপর তোমার যখনই ইচ্ছে হবে, ক্যাসেট বাজিয়ে শুনবে। নইলে যেটা প্রায়ই হচ্ছে, তোমার-আমার ইচ্ছে আর সময় খাপ খাচ্ছে না। এই এখন যেমন আমার মুড নেই।’
‘কেমন উদ্ভট লাগছে শুনতে,’ স্ত্রী বলল অবাক হয়ে। ‘তবে চেষ্টা করে দেখা যায়।’
ক্যাসেট ভর্তি করে আদরমাখা কথা রেকর্ড করলাম। এবং এরপর যা শুরু হলো: সময়ে-অসময়ে সে ক্যাসেট চালু করে কথাগুলো শুনতে থাকে। আমার বিরক্তি লাগতে শুরু করল রীতিমতো। একদিন রাতে তো আমার ঘুমই ভেঙে গেল নিজের রেকর্ডকৃত প্রেমমণ্ডিত বাণীগুচ্ছ শুনে। সহ্য করলাম আমি বেশ কিছুদিন, তারপর স্ত্রীকে বললাম আমার জন্যও আদরমাখা কথা ক্যাসেটে রেকর্ড করে রাখতে। আমি কি মানুষ না নাকি! আমারও তো আদর পেতে ইচ্ছে করে।
মনে আছে, শুনে খুব চেঁচামেচি করেছিল স্ত্রী। চোখ-মুখ তার লাল হয়ে উঠেছিল। আমার খুব কষ্ট হতে লাগল তার জন্য।
‘তুমি এক কাজ করলেই তো পারো,’ বললাম তাকে, ‘তোমার এই চিৎকার আর অভিশাপ ক্যাসেটে রেকর্ড করে রাখো। প্রয়োজন হলেই চালু করে দেবে। তোমার কষ্ট আর মন খারাপ কম হবে তাহলে।’
স্ত্রী সেটাই করল। তবে অন্য একটি ব্যাপার আমাকে ক্লান্ত করে তুলল—প্রতিদিন ঘুরেফিরে একই কথা বলে স্ত্রী: মেঝে মোছো, আলু কিনে নিয়ে এসো…
স্ত্রীকে অনুরোধ করলাম এই কথাগুলোও রেকর্ড করে রাখতে। একই কথাই তো প্রতিদিন।
অচিরেই বলার আর কোনো বিষয় রইল না আমাদের। প্রায়ই এমন হয়, আমি বসে থাকি আর্মচেয়ারে, উপভোগ করি নীরবতা, প্রশান্তি। মাঝেমধ্যে ক্যাসেটে বেজে ওঠে আমার আদরমাখা কথা অথবা স্ত্রীর চিৎকার-অভিশাপ।
একদিন স্ত্রী আমাকে এসে বলল, ‘তোমার জন্য একটা খারাপ সংবাদ আছে।’
‘বলো।’
‘এভাবে বসবাস করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আমি ভালোবেসে ফেলেছি আরেক পুরুষকে।’
‘তাতে কী হয়েছে!’ বললাম তাকে। আমার সঙ্গে তাকে কথা বলতে শুনে ভারি অবাক হলাম। তার সত্যিকারের গলা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম।
‘আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে তার সঙ্গে থাকব।’
আমি ভাবতে শুরু করলাম, তার অভিসন্ধিটা কী!
‘আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ, তাই তো?’ প্রশ্ন করলাম তাকে। ‘সরাসরি বললেই পারতে! আচ্ছা, ঠিক আছে, যাও, আমার আপত্তি নেই।’
আমাকে ছেড়ে গেল সে। এরপর আমি ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি একাকিত্বে। যদিও থেকে থেকেই মনে হয়, কিসের যেন অভাব বোধ করছি…
দুঃখের কথা এই যে ক্যাসেটীয় আদর সে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে, রেখে গেছে শুধু চিৎকার-অভিশাপ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৪, ২০১২
Leave a Reply