এতক্ষণ ভদ্রলোককে কেউই লক্ষ করেনি। ভদ্রলোক মেজের এক প্রান্তে দেয়াল ঘেঁষে গালে হাত দিয়ে বসে ছিলেন।
ঘরময় দুরন্ত উত্তেজনা ও বিশৃঙ্খলা। পুলিসের লোক, খবরের কাগজের লোক—কে কাকে লক্ষ করে! একটু আগে বাজারের পেছনে ব্যাঙ্কের এই একতলার ঘরে ডাকাতি হয়ে গেছে।
পুলিসের কর্তারা ব্যাঙ্কের এজেন্ট ও ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে ডাকাতির বিবরণ ও অপহূত অর্থের পরিমাণ জেনে নিচ্ছিলেন। স্থানীয় থানার ছোট দারোগাবাবু তাঁর কালো নোটবুকে টুকে নিচ্ছিলেন, তা হলে একশো টাকার নোটের বাণ্ডিল সাতাশটা, পঞ্চাশ টাকার নোটের বাণ্ডিল সতেরোটা, কুড়ি টাকার নোটের…’ এমন সময়ে ভদ্রলোক হঠাৎ ঘরের অন্যপ্রান্ত থেকে উঠে এসে দারোগাবাবুর সামনে কিরকম যেন হাঁটু মুড়ে আধা ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন।
ভদ্রলোকের ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি হ্যান্ডলুমের ঘন গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবিটির ঝুল বেশ লম্বা এবং তাই রক্ষা, কারণ তাঁর নিম্নাঙ্গ সম্পূর্ণ শূন্য, কোনো কাপড়-চোপড় নেই। পাঞ্জাবির কাপড় বেশ মোটা বলে পাঞ্জাবির তলায় কোমরের নিচে কিছু আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না।
ভদ্রলোককে লক্ষ করা মাত্র তাড়াতাড়ি পুলিসকে দেখিয়ে ব্যাঙ্কের এজেন্ট সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘এই তো যার কথা বলছিলাম, এই যে…।’ ভদ্রলোকের আশ্চর্য পোশাক এবং বিহ্বল চেহারা আর তার সঙ্গে এজেন্ট সাহেবের উত্তেজনা দেখে, পুলিসের এক কর্তা যিনি কাউন্টারে হেলান দিয়ে এতক্ষণ কাউন্টার টিপে টিপে কতটা শক্ত পরীক্ষা করে দেখছিলেন, তিনি মুহূর্তে বুঝে ফেললেন, এই ব্যক্তি অবশ্যই ডাকাতদের একজন। তিনি চাপা গলায় নির্দেশ দিলেন, ‘অ্যারেস্ট হিম।’ সঙ্গে সঙ্গে দুজন সেপাই দুদিক থেকে ছুটে গেল।
কিন্তু এরই মধ্যে এজেন্ট, ক্যাশিয়ার সবাই হা-হা করে উঠলেন, ‘আরে করেন কি? করেন কি? উনি ডাকাত নন।’
‘উনি ডাকাত নন, তাহলে উনি কি?’ পুলিশের ছোট সাহেব গর্জে উঠলেন।
‘উনি মিস্টার ছকু চৌধুরী। বাঁশের ব্যবসায়ী। আমাদের ক্লায়েন্ট।’ ব্যাঙ্কের তরফে এই উত্তরে চমকিত হয়ে পুলিসেরা একটু নিরস্ত হলেন, শুধু ছোটসাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের ব্যাঙ্কের ক্লায়েন্টরা আজকাল এই রকম পোশাক পরে আসেন নাকি?’
ছকু চৌধুরী এতক্ষণে হাত জোড় করে পুলিস সাহেবের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক দাঁড়িয়েছেন বলা যায় না, পা দুটো হাঁটুর কাছে ত্রিভুজের মতো ভাঁজ করে পাঞ্জাবির ঝুল দ্বারা যতটা লজ্জা নিবারণ করা সম্ভব তার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
পিছনে থানার জমাদারসাহেব রুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর উপরওলাদের সম্মুখে এই অর্ধোলঙ্গ ব্যক্তিটির দাঁড়ানোর ভঙ্গির এই বেয়াদবি তার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব। জমাদার রুল উঁচিয়ে বললেন, ‘এই, সিধা হো যাও, সোজা দাঁড়াও।’
জমাদারের আদেশ পেয়ে ছকু চৌধুরী কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন, ‘না স্যার, আমাকে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বলবেন না। সে আমি পারব না।’
অবশ্য এত কাকুতি-মিনতি করার প্রয়োজন ছিল না। প্রায় সবাই ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন ছকু চৌধুরী এতক্ষণ যে কারণে মেজেতে বসে ছিলেন এখন সেই কারণেই বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লজ্জা নিবারণ ছাড়া তাঁর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।
সদ্য ডাকাতি হওয়া ঘরের আবহাওয়া আগেই থমথমে ছিলো, এর পরে আরো থমথমে হয়ে উঠলো। সবাই চুপচাপ। অবশেষে পুলিসের ছোটসাহেব নীরবতা ভাঙলেন, ‘আপনি ডাকাত নন, ঠিক আছে। কিন্তু আপনি শুধু পাঞ্জাবি পরে ব্যাঙ্কে এসেছেন কেন? ভদ্রসমাজে যাতায়াত নেই আপনার?’
ছকু চৌধুরী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘না স্যার, আমার লুঙ্গি…,’ সঙ্গে সঙ্গে ছকুবাবুর অর্ধসমাপ্ত বাক্যটি ব্যাঙ্কের এজেন্টসাহেব অনুমোদন করলেন, ‘হ্যাঁ, ছকুবাবুর লুঙ্গি…।’
ডাকাতির তদন্তের মধ্যে এইরকম একটি সামান্য লুঙ্গির প্রসঙ্গ আসায় পুলিসের লোকেরা খুব চটে উঠলেন, ছোটসাহেব আবার ধমকে উঠলেন, ‘কিসের লুঙ্গি? এসব কি ইয়ার্কি হচ্ছে?’
এবার ছকুবাবু একেবারে মুষড়িয়ে পড়লেন, ‘স্যার, আমার লুঙ্গিটা ডাকাতেরা কেড়ে নিয়ে গেছে।’ পুলিস সাহেবদের অবাক হবার পালা, ‘লুঙ্গি ডাকাতেরা কেড়ে নিয়ে গেলো? সোনার সুতো দিয়ে বোনা, নাকি বেনারসি লুঙ্গি? ডাকাতদেরও কি আজকাল কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে?’
ব্যাঙ্কের ক্যাশিয়ারবাবু ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘না, ঠিক তা নয়; ডাকাতদের টাকা বেশি হয়ে গিয়েছিলো। তারা বোধহয় আশা করেনি যে এত টাকা পাবে। দুটো মাত্র বড় বড় বাজারের থলে এনেছিলো, সে দুটো পুরোপুরি ভরে গেলে তখন কি আর করবে, সামনের কাউন্টারে ছকুবাবু টাকা জমা দিতে এসেছিলেন, ওঁকে দুজনে মিলে জাপটিয়ে ধরে ওঁর লুঙ্গিটা খুলে নিয়ে বাকি টাকা বস্তার মতো করে বেঁধে ফেললো।’
পুলিস সাহেব হতবাক, ‘বলেন কি মশায়? লুঙ্গিটা খুলে নিয়ে নিলো?’
ছকুবাবুর পক্ষ সমর্থন করে ক্যাশিয়ারবাবু বললেন, ‘ছকুবাবু খুব ভালো লোক, স্যার। আমাদের পুরনো কাস্টমার। প্রথমে উনি কেন, আমরা কেউই ধরতে পারিনি, ডাকাতেরা কেন ওঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমরা ভাবলাম ডাকাতেরা ভেবেছে ওঁর কাছে অনেক টাকা আছে, কিন্তু ওঁর ওই সামান্য দু’ হাজার আড়াই হাজার টাকা ডাকাতেরা ছুঁলো না। শুধু ওঁকে ধরে ওঁর লুঙ্গিটা খুলে নিলো। ছকুবাবু যখন বুঝতে পারলেন যে লুঙ্গিটা খুলে নিচ্ছে, তিনি যথেষ্ট বাধা দিয়েছিলেন স্যার, কেন দেবেন না, বলুন। অমরাও হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, না হলে স্যার, ব্যাঙ্ক ডাকাতি তো সব জায়গাতেই হচ্ছে, আমাদের সব টাকাই তো ইন্সিওর করা, আমাদের তাতে কিছু এসে যায় না, কিন্তু ব্যাঙ্কের ভিতর থেকে পুরনো খদ্দেরের লুঙ্গি নেবে, এ কি রকম অত্যাচার!’
ক্যাশিয়ারবাবুর ভরসা পেয়ে পুলিসদের হতবাক অবস্থা দেখে ছকুবাবু এতক্ষণে একটু সাহস অর্জন করেছেন, পুলিস সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমার কি হবে?’ পুলিস সাহেব এবার একটু ঠাণ্ডাভাবেই বললেন, ‘কি হবে আপনার, যা শুনলাম, আপনার টাকা-পয়সা তো কিছু যায়নি! এখন কিছুক্ষণ ওই সিঁড়ির নিচে চুপচাপ বসে থাকুন। তারপর সন্ধ্যার সময় যেই লোডশেডিং হবে, অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বাড়ি ফিরে যাবেন।’
‘কিন্তু আমি স্যার, আর বাড়ি ফিরতে পারবো না স্যার। লুঙ্গিটা আমার নয় স্যার।’ ছকু চৌধুরীর এই কথা শুনে পুলিসসাহেব আরো বিচলিত হলেন, ‘লুঙ্গিটা আপনার নয়?’
ছকু চৌধুরী আবার হাতজোড় করলেন, ‘স্যার, সত্যি বলছি স্যার, লুঙ্গিটা আমার শালার। দুদিনের জন্যে কলকাতায় বেড়াতে এসেছে, দুপুরে চৌরঙ্গীতে পাতাল রেলের গর্ত দেখতে বেরিয়েছে। ভাবলাম পাঁচ মিনিটের জন্যে যাই ব্যাঙ্কে টাকাটা জমা দিয়ে আসি। টাকা-পয়সা সব ঠিক রইলো, শুধু গেলো আমার শালার লুঙ্গিটা।’ ছকু চৌধুরী হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন, ‘আমার শালা যখন জানতে পারবে আমি তার লুঙ্গি পরে বেরিয়েছিলাম, আমি কি করে তাকে মুখ দেখাবো, আমার শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে আমি কি করে মুখ দেখাবো? ডাকাতেরা আমার এ কি সর্বনাশ করে গেলো, স্যার!’
ব্যাঙ্ক আর পুলিশের লোকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ছকু চৌধুরীর কান্না দেখতে লাগলেন। খবরের কাগজের লোকেরা ঝপাঝপ ছবি তুলতে লাগলেন।
পুনশ্চ: কোনো পাঠক বা পাঠিকার যদি এরকম সন্দেহ হয় যে এই কাহিনীর সঙ্গে সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোনো ডাকাতির খবরের কোনো সম্পর্ক আছে, তাঁর ভুল নিরসন করার জন্যে জানাই, এই কাহিনীর সঙ্গে কোনো বাস্তব ঘটনা বা চরিত্রের কোনো যোগাযোগ নেই।
তারাপদ রায়: ভারতীয় লেখক। জন্ম: ১৯৩৬, মৃত্যু: ২০০৭।
Leave a Reply