বাংলা ছোটগল্প আজ রুদ্র কাপালিক। বীণাপাণিকে তুষ্ট করে তরুণের রক্তে ঋদ্ধ হওয়াই এখন এর অভীষ্ট। গল্প রচনায় আত্মদানকারী নবীন লেখকের অভাব আছে তা নয়। তবে গল্পের দুনিয়াদারি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা নিয়ে তেমন সচল-সুঠাম কলম কার হাতে যে ঝলসে উঠবে বলা মুশকিল। প্রচুর গল্প ছাপা হচ্ছে। বইও বেরোচ্ছে অনেক। কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে’র আশঙ্কা থেকে মুক্ত হওয়ার সময় বোধহয় এখনো আসেনি। আশার কথা, গল্প নিয়ে একদিকে যেমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, অন্যদিকে অব্যাহত আছে প্রবল ধারায় ভালো গল্প রচনার চেষ্টাও। বাংলাদেশের গল্পে বাঁক-বদলের একটা নতুন প্রক্রিয়া সূচিত হয়েছিল আশির দশকে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত ছোটগল্প রচনায় মূলধারার পাশাপাশি আখ্যান নির্মাণে অথবা ভাষা ব্যবহারে যেসব তরুণ নিরীক্ষাধর্মী সৃষ্টির নতুন উন্মাদনায় আগ্রহী, রুবাইয়াৎ আহমেদ সেই দলের কনিষ্ঠদের একজন।
নাটক ও চলচ্চিত্র তাঁর অধ্যয়নের বিষয়। গল্পের নিরীক্ষায় তাই এর প্রভাব স্বাভাবিক। তেমনি বুনন কৌশলে কিংবা আখ্যান চয়নে ওই বিষয়াবলির রস ও রসদ তাঁর গল্পের পরিধিকে ব্যাপ্ত করার ব্যাপারে অনন্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
আত্মহনন কিংবা স্বপ্ন পোড়ানো আখ্যান-এ সাতটি গল্পেই এটা প্রমাণের নমুনা রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন রুবাইয়াৎ। তাঁর মনোযোগ যতখানি মানুষে, মানুষের জীবন যাপনে, প্রকৃতিতে, প্রতিদিনে; তার চেয়ে অধিক অনন্তলোকে, অচৈতন্যে, অনন্তযাত্রায়, অন্ধকারে, লুপ্তিচেতনায়। কোনো কোনো গল্পের পাতায় পাতায় উঠে আসে পুরাণ ও লোকগান, পদ ও পাঁচালি। চরিত্রের কথনে কিংবা ভাবজগৎ বিশ্লেষণেও এমনটি ঘটে: ‘কালের খাতায় ছড়ানো থাকে জীবনের কথকতা। একটি পথের সীমাতে বাধা সেই জীবনের ছক। এই বৃত্ত ভাঙি কীভাবে, যাবো কীভাবে পথের শেষে, ক্ষুদ্রবোধে সেই তো আমার বিপন্নতার মূলে। তাইতো বিদায় পৃথিবীর মায়া, ছিন্ন করে আপন ছায়া, ঘনঘুমঘোরে দিয়েছি আমি মধ্যবেলায় ডুব। তাতেই খুঁজি মুক্তি আমার তাতেই মানি পূর্ণতা। যা কিছু সব আলতো সৃজন, পদ-কথারা রইলো পড়ে, তোমার মাঝেই রইবো আমি, খুঁজো আমার সৃষ্টিতে।’ (‘আগুনের উৎসব’)
তীব্র শ্লেষ, ব্যঙ্গ বা বিদ্রূপ নিয়ে রূপকের অথবা অতিকল্পনার জগতেও ভ্রমণ করেন রুবাইয়াৎ। যেখানে সমাজের বৈষম্য, বিদ্বেষ, পুঁজিতন্ত্রের গ্যাঁড়াকলে বিঁধেপড়া মানুষ, সময় ও সংস্কৃতি জট পাকিয়ে থাকে। গল্পকারের জীবন-অভিজ্ঞতা ও জীবন অন্বেষণ পাক খায়, মুষড়ে পড়ে আর তখনই ভাবজগতের বড় বড় তল গ্রাস করে তাকে। লোকায়তের সঙ্গে মিশে যায় সাম্প্রতিক। লোকাচারের সঙ্গে এক কাতারে এসে দাঁড়ায় বৈভব-কাঙ্ক্ষার নানা ম্যাজিক। তার দেখা মানুষগুলো যেন পুতুল, কী এক অদৃশ্য সুতার টানে নাচছে। নিজের দোদুল্যমান বিশ্বাস যে পারম্পর্যে এসে দাঁড়াতে চায় তখন, সেখানে নাম আসে হুমায়ুন আজাদ, সেলিম আল-দীনের। আস্থা পান লেখক, ভাবনায় বিশ্বাস খুঁজে পান।
কাহিনি ফাঁদার তথাকথিত কোনো ঝোঁক নেই গল্পকারের। দেখা না দেখার ভুবন, বোঝা না বোঝার ভাবনা নিয়েই কাহিনির টুকরো টুকরো কিছু কোলাজের মধ্যে একটা ঐক্য রচনা করে গল্পের পটভূমি তৈরি করেন রুবাইয়াৎ। গল্পের ধারাবাহিকতায় পাঠকের মনোযোগ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই; ব্যথা তাঁর বিষয়ে। কী সেই বিষয়? প্রথমেই বলেছি, অনন্তলোক ও লুপ্তিচেতনা।
‘আগুনের উৎসব’ গল্পের আত্মহননকারী গায়ক, ‘একজোড়া রাজহাঁস ও ধবল জ্যোৎস্নার বিভ্রম’ গল্পের পারভেজ, ‘সমুদ্র দর্শনে একা যেতে নেই’ গল্পের জামিল অথবা ‘মৃত্যু’ গল্পে ভূমিকম্পের পর অন্ধকারে আটকে পড়া দুই যুবক প্রসঙ্গে লেখক—এরা সবাই একই উৎস্যজাত। অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধির আগুনে সেঁকে পরিবেশনায় পার্থক্য ঘটানো হয়েছে শুধু। একটু গভীরে তাকালেই বোঝা যায়, পক্ষান্তরে এরা গল্পকারের একান্ত ভাবনায় গড়া নিজেরই ছায়া মাত্র। অথচ যেকোনো একটি গল্পের একটি বা দুটি চরিত্রের মধ্য দিয়েই এরা এবং এদের ভাবনাসকল অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। এবং সেই চরিত্র নিজ গুণে অনায়াসে স্থায়িত্ব পেত পাঠকের চৈতন্যে।
সাতটি গল্পের চারটি থেকে চারজন মানুষের মনোজগতের একটা উদাহরণ তবে তোলা যাক—‘হেই মহাদেব, এত এত মানুষ আগুনে পোড়ায়া মিশায়া দিছ কোন অদেখা জগতে। ঐ অদেখা জগতই যদি মানুষের সত্য পরিণতি, তবে জগৎবাস কি প্রয়োজন!’ (‘আগুনের উৎসব’)
বাড়ি ফেরার পথে পারভেজ বাজারে ঢুকে পোড়ামাটির দোকানে এসে এক কুমারকে মাটির ব্যাংক রং করতে দেখে—‘মাটির ব্যাংকগুলো পারভেজের কাছে আশাভাণ্ডরূপে ধরা দেয়। এইসব ছোট ব্যাংকে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ জমায় তা দিয়ে বড়কিছু করার থাকে না। তারপরও জমায়। আশাবাদী মানুষ ছাড়া কোনো নিরাশাবাদী কী কখনো এই ভাণ্ডে পয়সা জমায়? জানা নাই। কী রাখে মানুষ ওই ভঙ্গুর মাটির পাত্রে? প্রতিটি পয়সা, প্রতিটি টাকার কয়েনের ঝনাৎ শব্দের সঙ্গে মানুষের আশা আর স্বপ্নেরাও তো বেজে ওঠে। আহা, আশাভাণ্ড তুমি দীর্ঘজীবী হও! তুমি বড় কিছু দিতে না পারলেও, স্বপ্ন ভেঙে দেউলিয়া হয়ে পালিয়ে যাবে না কখনো।’ (‘একজোড়া রাজহাঁস ও ধবল জ্যোৎস্নার বিভ্রম’)
স্টিমারের ডেকে এক বৃদ্ধের কথা শুনে চমকে ওঠে জামিল, ভাবে: ‘অন্তর্যের চোখ খোলা রেখে যে কেউ তবে পারে, জীবনের বেদনা মাড়িয়ে চলে যেতে সুখভোরের খোঁজে।’
‘যন্ত্রণার উল্টোপিঠের দিগন্তে অঙ্কিত থাকে এক সুবর্ণরেখা। সেই রেখা ধরা দেয় না সব চোখে। যে চোখে ধরা দেয় সে হয় বেদনাজয়ী, ততোধিক মানব।’ (‘সমুদ্র দর্শনে একা যেতে নেই’)
ভূমিকম্পের পর ভগ্ন দালানের অন্ধকারে আটকে যাওয়ার পর দুটি যুবকের করুণ পরিণতি দেখে গল্পকারের বয়ান: ‘মানুষের জীবন কত বিচিত্র আকাঙ্ক্ষায় ভর করে চলে প্রতিনিয়ত। অর্থ-খ্যাতি-ক্ষমতা-সন্তান আরও কত কী! এক জীবনে হয়তো এ সবকিছুই লুটিয়ে পড়ে কারো কারো পায়ে। আর কেউ কেউ রিক্ত শূন্য সীমাহীন অতৃপ্তি নিয়ে পাড়ি দেয় জীবন পেরিয়ে অন্যলোকে। সেখানে আর কোনো প্রাপ্তির সম্ভাবনা কিংবা আশঙ্কা কিছুই নাই।’ (‘মৃত্যু’)
রুবাইয়াতের উপস্থাপনার সঙ্গে তাঁর ভাষাভঙ্গিও পৃথক হতে চায়। আঞ্চলিক ভাষা আর পুঁথি-পাঁচালিতে তিনি হাতড়ে বেড়ান প্রিয় শব্দাবলি। উদ্দেশ্য, গল্পে আলাদা একটা মাত্রা সংযোজন। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেড়েক যদি ঠিকঠাক পোতা হয়, কালস্রোতে যদি ভেসে না যায়, তবে এতেই একদা পূর্ণ হবে আমাদের গল্পের ভান্ডার।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply