একটা গল্প লিখতে শুরু করে এক মাস ধরে যাতনায় ভুগছি বড়। লেখা দুই অনুচ্ছেদের বেশি এগোয়নি।
—বড় বড় লেখকদের অনেকেই কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখতেন,—আমার বাসায় বেড়াতে এসে কথায় কথায় বললেন এক খ্যাতিমান সমালোচক। —হেমিংওয়ের কথাই ধরুন না! তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লিখতেন। ওদিকে বালজাক লেখালেখির সময় কফি খেতেন অঢেল পরিমাণে।
পরের দিনটা আমি দাঁড়িয়ে কাটালাম টেবিলের পাশে। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে গিয়ে অনভ্যাসের কারণে কষ্ট হচ্ছিল বেজায়। কিন্তু অতীতের বিশ্ববিশ্রুত লেখকের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিপুল পরিমাণে পান করা কফি আমাকে চাঙা করে রাখছিল।
একসময় পরম ক্লান্তিতে ঢলে পড়ার আগে মগজ চিপে অন্তত একটি চলনসই বাক্য বের করার চেষ্টা করে গেলাম প্রাণপণ।
—ভিন্ন কিছু উদাহরণও আছে,—স্বেচ্ছাধ্বংসের পথ থেকে ফিরিয়ে এনে আমাকে বাঁচালেন এক সাহিত্যবিদ।—এই যেমন, মার্ক টোয়েন লিখতে পছন্দ করতেন শুয়ে শুয়ে।
প্রফুল্লচিত্তে তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করে ফেললাম আনুভূমিক আসন। যাবতীয় কর্মপদ্ধতির মধ্যে এই পদ্ধতিটি সবচেয়ে প্রীতিকর। তবে এর একমাত্র ত্রুটি এই যে, সব সময় ঘুম পায় শুধু। আমার সমস্ত অন্তর্শক্তি ব্যয় হতে লাগল মূলত ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধে। এবং এই যুদ্ধে এতটা শক্তিক্ষয় হতে শুরু করল যে, লেখালেখি বিষয়ে চিন্তা করার সুযোগও রইল না।
—শুয়ে শুয়েই যদি লিখতে হয়, তাহলে খাটে নয়, বাথটাবে শুয়ে লেখা উচিত,—এক সাংবাদিক-বন্ধু উপদেশ দিল। সে আরও জানাল আগাথা ক্রিস্টির সৃজনশীলতার রহস্য।—পাঠকের মাথায় ঘোরপ্যাঁচ লাগানো সব কাহিনি তিনি কিন্তু রচনা করেছেন বাথটাবে শুয়েই। এ ছাড়া তিনি প্রতিদিন আপেলও খেতেন কয়েক কেজি।
ফল আমার পছন্দ। প্রচুর পরিমাণে আপেল কিনে বাথটাবে শুয়ে রইলাম অনুপ্রেরণার অপেক্ষায়। মাথা খুব সক্রিয়, কাজ করছে নিখুঁতভাবে। কল্পনায় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি অদূর ভবিষ্যতের দৃশ্য: আমার গল্পের প্রথম পাঠকদের সঙ্গে আমার করমর্দন, পরিচিতজনদের উচ্ছ্বাস, সমালোচকদের স্তুতি। এমনকি প্রাপ্য সম্মানী খরচ করব কীভাবে এবং তাতে স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সে দৃশ্যও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কল্পনা করে ফেলেছি।
টেবিলে বসে গল্পটা লিখে শেষ করলাম।
এরপর পাণ্ডুলিপি নিয়ে সম্পাদকের কাছে গেলাম যখন, তিনি দুবার পড়ে দেখলেন গল্পটা, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলেন:
—আপনার নিজের পছন্দ হয়েছে?
—খুব যে পছন্দ হয়েছে, তা নয়,—স্বীকার করলাম আমি।
—নিজেদের লেখা পছন্দ না হলে প্রথিতযশা লেখকেরা কী করতেন, মনে আছে আপনার? এই ধরুন গিয়ে, নিকোলাই গোগল তাঁর ‘মৃত আত্মা’র দ্বিতীয় পর্ব লিখে আবার পড়ে দেখেছিলেন এবং তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি তখন পাণ্ডুলিপি নিয়ে কী করেছিলেন?
—পুড়িয়ে ফেলেছিলেন,—জ্ঞান জাহির করার সুযোগ ছাড়লাম না।
—ঠিক তাই,—বললেন সম্পাদক।
পূর্ববর্তী:
« মহাজন
« মহাজন
পরবর্তী:
মহাত্মা গান্ধীর জুতো »
মহাত্মা গান্ধীর জুতো »
Leave a Reply