মতলুব সাহেব ঠিক করলেন তিনি দুর্নীতি করবেন। অন্তত একবার হলেও দুর্নীতি করে দেখতে চান এর ‘ফজিলত’। সবাই এত দুর্নীতি করে, কেন করে… তিনি বিষয়টা বুঝতে চান। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি তাঁর অফিসের এক বড় কর্মকর্তার কাছে গেলেন, যিনি দুর্নীতির জন্য বুকার পুরস্কার পেতে অপেক্ষমাণ (অবশ্য দুর্নীতির জন্য বুকার পুরস্কার দেওয়া হয় কি না ঠিক জানি না)!
—স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
—ওয়ালাইকুম…। কী ব্যাপার?
—স্যার, কীভাবে অন্তত একটা দুর্নীতি করা যায়, সেটা জানতে এসেছি…
—মানে? ভ্রু কুঁচকে যায় বড় কর্মকর্তার।
—মানে, স্যার, আপনি তো প্রচুর দুর্নীতি করেছেন, তাই আপনার কাছে পরামর্শের জন্য…
—হোয়াট? আমি দুর্নীতি করেছি মানে?
—বাহ্, দুনিয়াসুদ্ধ লোক জানে আপনি অফিসের এক নম্বর দুর্নীতিবাজ অফিসার আর আপনিই সেটা জানেন না? আপনি তো মনে হচ্ছে উটপাখি…স্যার…
—উটপাখি মানে?
—কেন স্যার, আজকাল বিজ্ঞাপন দেখেন না, ‘উটপাখি নয়, মানুষের জীবন চাই’…
—গেট আউট, গেট আউট…
মতলুব সাহেব মন খারাপ করে বের হয়ে আসেন দুর্নীতিবাজ অফিসারের রুম থেকে। এ সময় আরেক ছোট কর্মকর্তা এগিয়ে আসেন তাঁর দিকে।
—স্যার।
—কী ব্যাপার?
—স্যার, আপনাদের কথাবার্তা আড়াল থেকে সব শুনেছি। অনুমতি দিলে কিছু পরামর্শ আমি দিতে পারি আপনাকে।
—ও আচ্ছা আচ্ছা…বলুন।
—স্যার, ছোটখাটো দুর্নীতি আমিও করি। বিষয়টা আসলে স্যার শুরু করতে হবে ঘর থেকে।
—মানে?
—মানে, স্যার, চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। স্যার, বাসায় বাজার কার হাতে?
—আমার স্ত্রীই করে সব সময়।
—এই তো পেয়েছি…। স্যার, কাল থেকে বাজারের দায়িত্ব আপনি নেন…বাজারের টাকা থেকে টুকটাক সরাতে শুরু করেন…তারপর এভাবেই একদিন…
আইডিয়াটা পছন্দ হলো মতলুব সাহেবের। তিনি বাসায় এসে ঘোষণা দিলেন:
—কাল থেকে আমি বাজার করব।
—তুমি বাজার করবে? স্ত্রী অবাক!
—হ্যাঁ, সমস্যা কী? তুমি তো বহুদিন বাজার করলে, এবার বিশ্রাম নাও…স্বামী হিসেবে আমারও একটা দায়িত্ব আছে সংসারের প্রতি।
স্ত্রী খুশি হলেন, যাক, এত দিনে তার স্বামী একটু সাংসারিক হয়েছে, মন্দ কী। খুশি মনে পরদিন বাজারের ব্যাগ আর টাকা তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আর বললেন, ‘দেখো, পচা মাছ আবার কিনে এনো না। শাকসবজি সব দেখেশুনে আনবে…আর হ্যাঁ, ভালো দেখে একটা কাপড় কাচার সাবান আনবে।’
—কিচ্ছু চিন্তা কোরো না…খুশি মনে বের হয়ে গেলেন স্বামী টাকা আর বাজারের ব্যাগ নিয়ে।
কিছুক্ষণ বাদেই বাজার নিয়ে ফিরলেন। স্ত্রী হতভম্ব। সবই পচা মাল নিয়ে ফিরে এসেছেন। শুধু সাবানটা ভালো…এক নং পচা সাবান!
—এসব কী কিনেছ? আর এত উল্টাপাল্টা দাম। এই ইলিশ তিন শ টাকার বেশি হতেই পারে না আর তুমি কিনেছ পাঁচ শ টাকায়। দশ টাকার শাক বিশ টাকায়…দেখি টাকার হিসাব দাও।
—আরে হিসাব দিব কি, সব টাকা খরচ। স্বামী হাসেন। হাসার কারণ তিনি ভালো মার্জিন করেছেন। তাঁর প্রথম দুর্নীতি! চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম। হোক না নিজের টাকা নিজেই মেরেছেন। মেরেছেন তো!
খুব শিগগির সেই ছোট কর্মকর্তা আবার এলেন তাঁর কাছে।
—স্যার, ভালো একটা সুযোগ এসেছে।
—কিসের সুযোগ?
—কেন স্যার, দুর্নীতির। আমরা ঢাকা শহরে দশটা ওভারব্রিজ করার কাজ পেয়েছি…টেন্ডার…ওয়ার্ক পারমিট…বিল পাস…সব স্যার আপনার হাতে। এই যে স্যার ম্যাপ, কোথায় কোথায় ওভারব্রিজ হবে।
—কিন্তু দুর্নীতিটা হবে কীভাবে?
—এই যে, স্যার, অরিজিন্যাল ম্যাপে দেখছেন, যেখানে যেখানে ওভারব্রিজ হবে, আমরা সেখানে সেখানে করব না…আমরা করব এখানে এখানে…আমি দাগ দিয়ে রেখেছি…এটা, স্যার, নকল ম্যাপ।
—কিন্তু নকল ম্যাপের এসব জায়গায় ওভারব্রিজ হলে জনগণের লাভ কী?
—স্যার, জনগণের লাভ দেখতে গেলে কি আর দুর্নীতি করা যায়?
—কী বলছেন এসব?
—ঠিকই বলছি, স্যার। দুর্নীতি করবেন আবার জনগণের ভালোও চাইবেন? দুইটা কি একসাথে হয়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মতলুব সাহেব। বিষণ্ন ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন:
—ঠিকই বলেছেন, দুুইটা একসাথে হয় না। বরং একটাই করি…
—কোনটা, স্যার?
কথা বলেন না মতলুব সাহেব। নকল ম্যাপটা ছিঁড়ে ফেলেন টুকরো টুকরো করে। ছোট কর্মকর্তা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মতলুব সাহেবের দিকে। ভাবেন, ‘ধেৎ, বেটাকে উটপাখি বানানো গেল না।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ০৫, ২০১১
Leave a Reply