আমাকে ডেকে পাঠালেন পিওতর সভিরিদভিচ।
‘আচ্ছা, বলুন তো,’ আলমারি আর লক বক্সের মাঝামাঝি উদাস চোখে তাকিয়ে তিনি চিন্তিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি এখন কী করছেন?’
‘কী করছি মানে?’ সপ্রতিভ উত্তর আমার? ‘নানান ধরনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।’
‘যেমন?’
‘যেমন? এই ধরুন গিয়ে…নানাবিধ সমস্যার সমাধান করছি।’
‘কী কী সমস্যা?’
‘ইয়ে মানে, বেশ কিছু সমস্যা…’
‘ঠিক কোন সমস্যাগুলো?’
‘যেসব সমস্যার মুখোমুখি প্রতিদিন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় জীবন।’
‘কী সব সমস্যার মুখোমুখি জীবন আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়?’
‘বাস্তব কিছু সমস্যা।’
‘বাস্তব এই সমস্যাগুলোর সারকথা কী?’
‘ইয়ে মানে, বাস্তব এই সমস্যাগুলোর…আচ্ছা, শুনুন, আপনি কী চান আমার কাছে? আমার চাকরি খাবেন? তাহলে সতর্ক করে দিয়ে বলি: কাজটা অত সহজ হবে না। আমি এখানে চাকরি করছি বহু বছর ধরে।’
‘আমি শুধু জানতে চাইছি, কী নিয়ে কাজ করেন আপনি?’
‘কী নিয়ে মানে? সবাই যা নিয়ে কাজ করে, আমিও তা-ই করি।’
‘সবাই কী নিয়ে কাজ করে?’
‘সবাই যা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন, তা নিয়েই করে।’
‘হুমম।’ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন পিওতর সভিরিদভিচ। ‘প্রশ্নটাকে অন্যভাবে উপস্থাপন করা যাক: অফিস আওয়ারে আপনাকে কী কী কর্তব্য পালন করতে হয় প্রতিদিন?’
‘এক দিনের সঙ্গে আরেক দিনের মিল নেই তো…’
‘তাহলে এক মাসের কথাই না হয় ধরা যাক?’
‘নির্দিষ্ট কোনো ধরন নেই। তবে আমি কাজ করি বিবেকবানের মতো, সুচিন্তিতভাবে ও সোৎসাহে…।’
‘কী নিয়ে কাজ করেন?’
‘আবার শুরু করলেন! আমি তো বলেইছি, আমার ধারণা…’
‘প্রশ্নটা এবার ভিন্নভাবে করি: আপনার ডিপার্টমেন্টে আপনার কলিগরা কী করে?’
‘যে যার দায়িত্ব পালন করে।’
‘নিজের দায়িত্বই তো পালন করবে, অন্যেরটা নয় নিশ্চয়ই। কিন্তু তাদের দায়িত্বের সারকথাটা কী? ধরুন, আপনি অফিসে এলেন, বসলেন নিজের জায়গায়।’ ‘তারপর?’
‘তারপর আর কী? কাজ করি। আমি তো বলেইছি সে কথা।’
‘আচ্ছা, আপনার ডিপার্টমেন্টের কাজ কী?’
‘কর্তব্য পালন করা।’
পকেট থেকে রুমাল বের করে পিওতর সভিরিদভিচ ঘর্মাক্ত কপাল মুছলেন।
‘আপনি কি শেষমেশ বলবেন, আপনার ডিপার্টমেন্টের কাজ কী?’ চিৎকার করে উঠলেন তিনি। ‘মাটির পাত্র বানানো? মোজা বোনা? নাকি মুরগির পালক বাছা?’
‘মুরগির কথা আসছে কেন?’ মনটা খারাপ হলো আমার। ‘নাকি আমি বাসা থেকে চিকেন স্যান্ডউইচ নিয়ে আসি বলে খোঁটা দিলেন? চান তো আর আনব না।’
‘যে ডিপার্টমেন্টে আপনি কাজ করেন, সেটার নাম কী?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন প্রায় ফিসফিস করে।
স্মৃতিশক্তিকে সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় করার প্রাণপণ চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। নাম মনে করতে পারলাম না।
‘লম্বা একটা নাম—সাত কিংবা এগারো শব্দের,’ বললাম আমি।
‘আর আপনি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, সেটার নাম কী?’ তিনি প্রশ্ন করলেন একেবারে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে।
ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শরীরে। এই নামটা মগজের কোথাও আছে বটে, কিন্তু সেখান থেকে বের করতে পারলাম না কিছুতেই। ‘এই নামটাও দীর্ঘ, তবে আমার ডিপার্টমেন্টের নামের চেয়ে ছোট,’ আমি বললাম।
‘ডিপার্টমেন্টের নামের চেয়ে ছোট বলছেন?’
‘অনেক ছোট। তিন বা পাঁচ শব্দ কম হতে পারে।’
‘কিন্তু আমাদের প্রতিষ্ঠানের নামটা কী?’ শ্লেষমাখা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম নীরবে। কিন্তু জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোয় যেমন হয়ে থাকে, কোত্থেকে উদ্ধারকারী এক আইডিয়া এল মাথায়। পিওতর সভিরিদভিচ তাকিয়ে ছিলেন ছাদের দিকে। আমি তাঁর অলক্ষে পকেট থেকে পরিচয়পত্র বের করে পড়তে শুরু করলাম, ‘এন্টারপ্রাইজ অব সুপারভিশন…’
‘যথেষ্ট, যথেষ্ট,’ প্রফুল্ল স্বরে তিনি বললেন। ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের নাম এবার আমারও মনে পড়েছে। অর্ধেক দিন ধরে মনে করার চেষ্টা করছিলাম। আপনাকে ডেকেছিলাম মনে করিয়ে দিতে। এখন গিয়ে কাজ করুন। ধন্যবাদ।’
(সোভিয়েত আমলে রচিত এই গল্পে এক সরকারি অফিসের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ৩১, ২০১১
Leave a Reply