বলতে পারেন কি এই শরীরটার সব অঙ্গগুলির মধ্যে সবচেয়ে অনাদরে উপেক্ষিত হয়ে রয়েছে কে? একটু ভাবলেই সকলে একবাক্যে জবাব দেবেন: ‘পিঠ’। আয়তনের দিক দিয়ে একক গরিষ্ঠতা যে-অংশটির, সেটিই সবচেয়ে অবহেলিত—এমনতর পরিহাস সাহারা মরুভূমি ছাড়া আর কারো ভাগ্যে দেখা যায়নি। পিঠ হল শরীরের ‘পশ্চাৎপদ দেশের’ অনুকল্প—তাই Back ward মানেই পশ্চাৎপদ।
সব দিক দিয়ে শোষিত এই পিঠের পক্ষ নিয়ে আজ পর্যন্ত কেউ দুটো সহানুভূতির কথা বলল না।
কত সাহিত্যে, কত কাব্যে রূপ বর্ণনার কত দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা দেখলাম: ‘মাথার চুল থেকে কপাল, ভ্রূ, চোখ, নাক, গাল, ঠোঁট, দাঁত, চিবুকের তো কথাই নেই—ওরা হচ্ছে Priviledged section; কিন্তু বর্ণনার বৈচিত্র্যে কমল-কর চম্পক অঙ্গুলি, মৃণাল-বাহু; কপাটবক্ষও কম যায় না। কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি; কবিদের কল্যাণে পা পর্যন্ত উতরে গেছে, অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে কালিদাসকে ঠেকানো যায়নি শ্রোণী-শিলা বর্ণনায়; কাঁধ আর তলপেট পর্যন্ত ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের দৌড় দেখেছি। কিন্তু এত বড় বিরাটত্বের মহিমায় মহীয়ান পিঠ আজ পর্যন্ত যে আঁধারে, সেই আঁধারে।’
অথচ কেন? কোনো আধুনিকার বুকের উপর যে-বেণীটি লুটিয়ে পড়েছে, তাকে নিয়ে এত মাতামাতি করতে পারো আর পিঠের উপর লুটোলে তোমাদের কবিতার উচ্ছ্বাসে পিঠ-বেচারীর নামোল্লেখ পর্বটা করতেই তোমাদের কলমের কালি আর মনের রং ফুরিয়ে যায়—এ কেমন কথা? তোমার আগে-আগে চলা যে মেয়েটির পেছন দিক দেখতে দেখতে তুমি মোটর চাপা পড়ার উদ্যোগ করছ, তার পায়ের নৃত্যভঙ্গী দেখবে, মসৃণ গলার এতটুকু ফালির উপর সূক্ষ্মতম স্বর্ণরেখাটি তোমার চোখ এড়াবে না, অথচ মাঝখানে অত বড় পিঠখানা তুমি সত্যি লক্ষ করোনি—এ কি তাজ্জব ব্যাপার নয়?
এই পর্যন্ত পড়ে যে রুচিবাগীশ বিকৃত মস্তিষ্কের দল লাঠি নিয়ে তাড়া করবেন, তাঁদের কাছে দেহতত্ত্বের এই গূঢ় রহস্য বোঝানোর চেষ্টা নিশ্চয় বৃথা। অতএব আমাকে পলায়ন করতে হবে—অর্থাৎ পৃষ্ঠপ্রদর্শন করতে হবে। এই ‘পৃষ্ঠপ্রদর্শন’ শব্দটা থেকেই বুঝবেন, পিঠের মতো বন্ধু আমাদের আর কেউ নেই। একদিন পিঠ ছিল সন্ধিকামনার দ্যোতক, ব্যক্তিগত শ্বেত-পতাকা; যুদ্ধ করতে গিয়ে শেষে নিতান্ত বেকায়দায় পড়েছেন, কেবলমাত্র আপনার চির-উপেক্ষিত পিঠখানাকে ঘুরিয়ে শত্রুর সামনে ধরুন—ব্যস। আপনার গণ্ডারচর্মের ঢাল যা করতে পারেনি, আপনার স্বচর্ম-রচিত পিঠ অনায়াসেই আপনাকে অস্ত্রাঘাত থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু মানুষই পিঠের এ মহিমা থাকতে দিল না; বারংবার এপিঠ-ওপিঠ করতে গিয়ে শান্তির দূত পিঠকে করে ফেলল আক্রমণের মুখে একটা কামোফ্লেজ মাত্র। তখন থেকে শুধু পৃষ্ঠপ্রদর্শন নয়, সঙ্গে সঙ্গে পলায়ন না করে আর বাঁচোয়া নেই। তবু পিঠ আজো যতটা আঘাত সহ্য করে মানুষকে পলায়নের সুযোগ দিচ্ছে, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানভুক্ত হয়ে নেহরুকে ততটা সুযোগ দিতে পারেনি।
অথচ, এই পিঠের নিকটতম প্রতিবেশী পেটের মতো ওর অত বড় শত্রু আর নেই। ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি—পেটে খেলে পিঠে সয়। এমন কথা কেউ বলে না যে পিঠ গদীয়ান থাকলে পেট উপোস সহ্য করবে; যেন পিঠের একমাত্র কাজ হচ্ছে নিজে উত্তম-মধ্যম হজম করে পেটকে উত্তম-মধ্যম হজম করার সুযোগ দেওয়া। সরকারি শ্রমসচিব যখন শ্রমিকদের কম মাইনে নিয়ে বেশি কাজ করতে বলেন, তখনো সেটা এত বড় পরিহাসের মতন শোনায় না।
আসলে পিঠ বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে পড়ে থাকে; আমাদের নিজেদের চক্ষু কোনোদিন তার পরিচয় লাভ করতে পারে না। পিঠের এই হেনস্তার মূল হচ্ছে এই অন্তরালে বাস। যে-রত্ন উজ্জ্বলতম জ্যোতি ছড়িয়ে চিরকাল পড়ে রইল সমুদ্রের অতলে, যে-ফুল নির্জন বনভূমিকে চকিত করেই শুধু গন্ধ বিলিয়ে গেল—তাদের সঙ্গে তুলনা হয় এই অনাদৃত অঙ্গের। তাই তো আজীবনের অনুচর এই পিঠের স্থান মেলে না কোথাও, যেমন মেলে না লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক মিল্টন আর ক্রমওয়েলের।
ইংরেজি Patron শব্দটির বাংলা অনুবাদ হয়েছে পৃষ্ঠপোষক। এমন সুন্দর অনুবাদ বড় দেখা যায় না। Patron-দের সব কারবারই পেছনে, পিঠের দিক থেকে। কক্ষনো কোনো Patron-কে কোনো কাজের সামনে দেখা যায় না, তাঁদের যেটুকু পুষিয়ে নেওয়ার সেটুকু সবার পৃষ্ঠ থেকেই নিয়ে থাকেন। ওঁদের পেট-ron না ‘পিঠ-ron’ বলাই বোধহয় উচিত হবে। অবশ্য নজর তাঁদের পেটের দিকেই: নিজের পেট মেদবহুল করবার এবং আপনার পেট ফাঁসাবার।
যুগ যুগ ধরে এমনি অনাদৃত থাকার ফলে পিঠ আজ নিতান্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। একটু পিঠ চাপড়ে কত সহজেই তাকে খুশি করা যায়, পিঠে খাইয়েও বোধহয় ততটা করা সম্ভব নয়।
কিন্তু পিঠের অনাদরের দিন বোধহয় ফুরিয়ে এসেছে। অনেকেই আজ বুঝতে পারছে পেটে খেয়ে পিঠে সওয়া আর বেশি দিন নয়। তাই নেহরুকে দেখছি পিকিং সরকারকে তোয়াজ করতে উঠে পড়ে লাগতে, স্ট্যালিন সাহেবের মন রাখা কথা বলতে। কেন? না, পিঠ সামাল।
মহাজনও যেন গতঃ স পন্থা। অতএব আমাদেরও পিঠ সামলাতে হচ্ছে। পিঠে ছুরি না পড়ে, সেদিকের সাথে আরো লক্ষ রাখতে হবে পিঠ চাপড়ানোর ফলে সহজে না গলে যাই; আমরা বাঙালিরা পিঠে লাঠিঘুষি সইতেই এত অভ্যস্ত যে পিঠ চাপড়ানোতে বড় সহজেই বেড়ালের মতো ঘরঘর শব্দ করে চোখ বুজি; মহা-আনন্দে গেয়ে উঠি—রঘুপতি রাঘব রাজারাম। কিন্তু এবারে, ইলেকশন আসছে—পিঠ চাপড়ানোতে ভুললে অদূর ভবিষ্যতে পিঠে কুলো বেঁধেও কুলোবে না। শ্যাম-কুল দুই-ই যাবে।
নারায়ণ দাশশর্মা: ভারতীয় লেখক।
তাঁর এ সরস রচনাটি অচলপত্র তৃতীয় বর্ষ, ৪-৫ সংখ্যা, শ্রাবণ-ভাদ্র, ১৩৫৭ থেকে সংকলিত।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৭, ২০১১
Leave a Reply