হোটেলমালিক রামলগন হাঁ করে একবার গণেশের মুখের দিকে আরেকবার থালার দিকে তাকাচ্ছিল। গণেশের খাওয়া শেষ হতেই জিজ্ঞেস করল, ‘সাহেব, পেট ভরেছে?’
‘ভরেছে,’ আঙুল দিয়ে থালা চাটতে চাটতে বলল গণেশ।
‘আমি বুঝি, সাহেব। বাবা মারা যাওয়ার পর আপনার তো আর আপন কেউ রইল না। একা একা অনেক কষ্ট হয় আপনার।’ বলেই চলেছে রামলগন, ‘সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে কাজ করে খাচ্ছি। একা। আপনার মতো শিক্ষিত মানুষের কাছে হয়তো বা দোকানদারি অনেক ছোট পেশা, কিন্তু আমার কি কম আছে? পেনালে ১০ একর জমি; সাইপেরিয়ায় তিনটে, ফুয়েন্ট গ্রোভে একটা বাড়ি। সব মিলে মোটামুটি ১২ হাজার ডলারের সম্পত্তি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে রামলগন আবার বলল, ‘সাহেব, আপনার তো এখন দেখাশোনা করার কেউ নেই। আমার মেয়ে লীলাকে আপনি বিয়ে করবেন?’
‘করব,’ এককথায় রাজি হয়ে গেল গণেশ।
২
‘চিন্তা করবেন না। আমার তেমন কোনো দাবিদাওয়া নেই।’ রামলগনকে আশ্বস্ত করল গণেশ।
‘সাহেব, এই হিন্দুসমাজের যতসব প্রথা নিয়েই তো আমার ভয়। বিয়ের পরদিন দুপুরে বরকে পুরো এক থাল খিচুড়ি খেতে দিতে হয়। জামাই যতক্ষণ না খাওয়া শেষ করে ততক্ষণ পর্যন্ত শ্বশুরকে টাকা ঢালতে হয়।’
‘চিন্তা করবেন না। আমি তাড়াতাড়ি খেয়ে নেব। কিন্তু আবার এত দ্রুতও না, যাতে লোকে আপনাকে ফকির ভাবে।’
‘আমি এমনটাই আশা করেছিলাম, সাহেব। আপনিই পারেন এতটা উদার হতে। এটা আমার বিয়ে হলে আমি বলতাম, “চুলোয় যাক খিচুড়ি, আমি যৌতুক নেব না”।’
৩
বিয়ের কার্ড ছাপানো শেষ হতে না হতেই অতিথিরা পাল ধরে এসে পড়ল গণেশের বাড়ি। অতিথিদের কর্তৃত্বে ছিলেন গণেশের এক পিসি, যিনি কিনা গণেশের বাবার শ্রাদ্ধের যাবতীয় খরচ বহন করেছিলেন। গণেশ সেসব টাকা ফেরত দেওয়ার কথা তুলতেই কষে একটা ধমক খায় পিসির কাছে।
অতিথিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এত ছোট একটা বাড়িতে এত মানুষ কীভাবে থাকছে ভাবতেই গণেশের অবাক লাগে। আরও অবাক কাণ্ড হলো, এদের বেশির ভাগকেই গণেশ চেনে না। মাঝেমধ্যে দু-একটা মুখ চেনা চেনা ঠেকে এবং সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, তার যেসব দূরসম্পর্কের বোন কদিন আগে নিজেরাই ছিল খুকি, তারা আজ এক গন্ডা ছানাপোনার মা। লম্বামতো, চটপটে একটি মেয়েকে গণেশ কিছুতেই চিনতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, ‘পিসি, এই মেয়েটি কে?’
‘ও ফুলকুমারীর জ্যাঠতুতো বোন।’
‘ফুলকুমারীটা আবার কে?’
‘ফুলকুমারী তোর দূরসম্পর্কের খুড়তুতো বোন।’
সম্পর্কের ফিরিস্তি শুনে গণেশের বিষম খাওয়ার জোগাড়। বিয়ের আগের দিন বাড়ির সব মেয়ে হিন্দি গান গেয়ে গণেশকে জাফরান দিয়ে স্নান করাতে লাগল। তখনই প্রথমবারের মতো প্রশ্নটা করল গণেশ, ‘আচ্ছা পিসি, প্রতিদিন এতগুলো লোকের খাবার আসছে কোথা থেকে?’
‘কেন? রামলগন বাবুর হোটেল থেকে!’
‘খরচাপাতি কে দেবে?’
‘তুমি। রামলগন বাবু বলেছেন, নানা ঝামেলায় তোমার মাথাটা এমনিতেই গরম। বিলের ব্যাপারে বিয়ের পরই তিনি তোমার সাথে কথা বলবেন।’
‘হায় ভগবান! এখনো বিয়ে হলো না, এরই মধ্যে বুড়ো আমার ঘাড় মটকাতে শুরু করেছে!’ মনে মনে ভাবল গণেশ।
৪
অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেল। পরদিন যথারীতি উঠোনের ওপর কম্বল পেতে গণেশকে বসতে দেওয়া হলো। সামনে রাখা হলো সাদাটে, অখাদ্য খিচুড়ি। রামলগন খিচুড়ির পাশে কাঁসার থালায় ১০০ ডলার রাখল, কিন্তু গণেশ খিচুড়ির দিকে তাকাল না পর্যন্ত। অতিথিদের মধ্যে কেউ কেউ অল্প কিছু টাকা দিল। কিন্তু গণেশ চুপচাপ বসেই রইল। রামলগন আরও ১০০ ডলার রেখে বলল, ‘বাবা, এবার খাও।’
ভিড়ের মধ্য থেকে কে যেন বলল, ‘রামু, আরও পয়সা ঢালো।’
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে রামলগন বলল, ‘ও যেন ভুলেও না ভাবে যে আমি আরও টাকা দেব। ব্যাটা উপোস করে মরুক না। আমার কী?’ গজগজ করতে করতে চলে গেল রামলগন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আরও ২০০ ডলার ফেলে ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা সাহেব, আমাকে দেওয়া কথা ভুলো না। খাও।’
‘খাবে না, খাবে না।’ ভিড়ের মধ্য থেকে চেঁচিয়ে বলল কে যেন।
‘দূর হ, ব্যাটা।’ খেঁকিয়ে উঠল রামলগন। আবার ফিসফিসিয়ে গণেশকে বলল, ‘সাহেব, আর লজ্জা দেবেন না। দয়া করে খেয়ে নিন।’ গণেশ নড়ল না। শেষমেশ রামলগনের কাছ থেকে একটি গরু, একটি বাছুর, নগদ ১৫ হাজার ডলার আর ফুয়েন্ট গ্রোভের বাড়িটা লিখে নেওয়ার পর গণেশ খায়। গণেশের বাড়ির এত দিনের খাবারের বিলও বাতিল করতে হলো রামলগনকে।
‘আমরা তো ঠাট্টা করছিলাম। ও আগে থেকেই জানত, আমি ওকে এগুলো দিয়ে দেব।’ দরদর করে ঘামতে ঘামতে বলল রামলগন।
ভি এস নাইপল: ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে জন্মগ্রহণকারী ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোবেল ও বুকারজয়ী ব্রিটিশ লেখক। জন্ম ১৭ আগস্ট, ১৯৩২।
অনুবাদ: আলিয়া রিফাত
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১২, ২০১১
Leave a Reply