আমি তীর্থপ্রাণ। অর্থাৎ তীর্থ দেখলেই ফুল চড়াই, ‘শীরনী’ বিলাই। ভারতীয় তাবৎ তীর্থ যখন নিতান্তই শেষ হয়ে গেল তখন গেলুম জেরুজালেম। ইহুদি, খ্রীষ্টান, মুসলমান এই তিন ধর্মের ত্রিবেণী জেরুজালেম। বিশ্বপাণ্ডার ইউএনও ঐখানেই। সেখান থেকে গেলুম বেৎ লেহেম—প্রভু যীশুর জন্মস্থান।
বড়দিনের কয়েক দিন পরে গিয়েছিলুম। জেরুজালেম-বেৎ লেহেমের বাস-সার্ভিস আমাদের স্টেট বাসের চেয়ে অনেক ভালো (বাসের ওপর পলায়মান ব্যাঘ্রের ছবি এঁকে কর্তারা ভালোই করেছেন—বাঘ পর্যন্ত ভিড় দেখে ভয়ে পালাচ্ছে)। পকেটে গাইডবুক—পাণ্ডার ‘এরজাৎ স’—কাঁধে ক্যামেরা—হাতে লাঠি। আধঘণ্টার ভিতর বেৎ লেহেম গ্রামে নামলুম।
ভেবেছিলুম, দেখতে পাব, বাইবেল-বর্ণিত ভাঙাচোরা সরাই আর জরাজীর্ণ আস্তাবল—যেখানে যীশু জন্ম নিয়েছিলেন। সব কপ্পুর। সবকিছু ভেঙেচুরে তার ওপর দাঁড়িয়ে এক বিরাট গির্জা।
গির্জাটি প্রিয়দর্শন অস্বীকার করি নে। আর ভিতরে মেঝের ওপর যে মোজায়িক বা পাথরে-খচা আলপনা দেখলুম তার সঙ্গে তুলনা দেবার মত রসসৃষ্টি সেন্ট সোফিয়া, সেন্ট পল কোথাও আমি দেখিনি। সে-কথা আরেক দিন হবে।
গাইডবুকে লেখা ছিল, গির্জার নিচে ভূগর্ভে এখনো আছে সেই আস্তাবল—যেখানে প্রভু যীশু জন্মগ্রহণ করেন। সেই গহ্বরে ঢুকতে যেতেই দেখি সামনে এক ছ-ফুটি পাণ্ডা। বাবরী চুল, মান-মনোহর গাল-কম্বল দাড়ি, ইয়া গোঁপ মিশকালো আলখাল্লা, মাথায় চিমনির চোঙার মত টুপি, হাতে মালা—তার এক একটি দানা বেবি সাইজের ফুটবলের মত। পাদ্রী-পাণ্ডার অর্ধ-নারীশ্বর।
গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে শুধাল, ‘হোয়াট ল্যান্গুইজ্? কেল লাঁগ? বেলশে শপ্রাখে? লিসান এ?’—প্রায় বারোটা ভাষায় জিজ্ঞেস করল আমি কোন ভাষা বুঝি।
সবিনয় বললুম, ‘হিন্দুস্থানী।’
বললে, ‘দসিপয়াস্তর’। অর্থাৎ দশ পিয়াস্তর (প্রায় এক টাকা) দর্শনী দাও।
‘দস্’ ছাড়া অন্য কোনো হিন্দুস্থানী সে জানে না বুঝলুম, কিন্তু তাই বা কি কম? আমি অবাক হয়ে ইংরেজিতে বললুম, ‘প্রভু যীশুর জন্মভূমি দেখতে হলে পয়সা দিতে হয়?’
বললে, ‘হ্যাঁ।’
অনেক তর্কাতর্কি হল। আমি বুঝিয়ে বললুম, ‘আমি ভারতীয়, খ্রীষ্টান নই, তবু সাত-সমুদ্র-তেরো-নদী পেরিয়ে এসেছি সেই মহাপুরুষের জন্মভূমি দেখতে যিনি সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছিলেন গরীব-ধনীর তফাত-ফারাক ঘুচিয়ে দেবার জন্য, যিনি বলেছিলেন কেউ কামিজটা চাইলে তাকে জোব্বাটি দিয়ে দেবে—আর তারই জন্মভূমি দেখবার জন্য দিতে হবে পয়সা?’
শুধু যে চোরাই ধর্মের কাহিনী শোনে না তা নয়। আমি উলটো পথ নিলুম—পাণ্ডা ফিরে পর্যন্ত তাকাল না।
গাইডবুকে লেখা ছিল, গহ্বরে যাবার দুটি রাস্তা। একটি গ্রীক অর্থডকস প্রতিষ্ঠানের জিন্মায়, অন্যটি রোমান ক্যাথলিকদের। গেলুম সেটির দিকে—গির্জাটি ঘুরে সেদিকে পৌঁছতে হয়।
এখানে দেখি আরেক পাণ্ডা—যেন পয়লাটার যমজ। বেশভূষায় ঈষৎ পার্থক্য।
পুনরপি সেই সদালাপ। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল।’ অম্মো না-ছোড়বন্দা।
দিল-দরাজ, খোলা-হাত পাঠক হয়ত অসহিষ্ণু হয়ে বলবেন, ‘তুমি তো আচ্ছা ত্যাঁদোড় বাপু; এত পয়সা খর্চা করে পৌঁছলে মোকামে—এখন দু-পয়সার চাবুক কিনতে চাও না হাজার টাকার ঘোড়া কেনার পর?’ তা নয়, আমি দেখতে চাইছিলুম পাণ্ডাদের দৌড়টা কতদূর অবধি।
এবারে হার মানবার পূর্বে শেষ বাণ হানলুম।
বললুম, ‘দেশে গিয়ে কাগজে লিখব, রোমান ক্যাথলিক প্রতিষ্ঠান কীরকম প্রভু যীশুর জন্মস্থান ভাঙিয়ে পয়সা কামাচ্ছে। আমাদের দেশেও কমুনিটি আছে।’
বলে লাঠিটা বার-তিনেক পাথরে ঠুকে ফিরে চললুম ঘোঁত-ঘোঁত করে বাসস্ট্যান্ডের দিকে।
পাণ্ডা ডাকলে, ‘শোনো।’
আমি বললুম, ‘হুঁঃ।’
‘তুমি সত্যি এত টাকা খরচ করে এখানে এসে দশ পিয়াস্তরের জন্য তীর্থ না দেখে চলে যাবে?’
‘আলবত। প্রভুর জন্মভূমি দেখার জন্য পয়সা দিয়ে প্রভুর স্মৃতির অবমাননা করতে চাই নে।’
খ্যাঁস খ্যাঁস করে দাড়ি চুলকোল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর ফিস্-ফিস্ করে কানের কাছে মুখ—বোটকা রসুনের গন্ধ—এনে বলল, ‘যদি প্রতিজ্ঞা করো কাউকে বলবে না ফ্রী ঢুকতে দিয়েছি তবে—’
আমি বললুম, ‘আচ্ছা, এখানে তোমার ব্যবসা মাটি করব না। কিন্তু দেশে গিয়ে বলতে পারব তো?’
তখন হার মানল। আমরা বহু লঙ্কা জয় করেছি!!
[সংক্ষেপিত]
সৈয়দ মুজতবা আলী: রম্যলেখক
জন্ম: ১৯০৪, মৃত্যু: ১৯৭৪
Leave a Reply