ফ্ল্যাটে ঢুকে মাথা থেকে হ্যাট খোলার সুযোগও হলো না আর্কাদি সেমিওনভিচের, স্ত্রী আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর ওপরে।
‘তুমি তোমার ছেলের পিতা, নাকি পিতা নও?’
‘সেটা তো তোমারই ভালো জানার কথা,’ হাসতে হাসতে বললেন আর্কাদি সেমিওনভিচ।
‘ঠাট্টা করছ!’ দুই হাত ঝাঁকিয়ে স্ত্রী বললেন। ‘তোমার ছেলের কীর্তিকলাপের কথা যদি জানতে!’
‘আমাকে ওভারকোটটা অন্তত খুলতে দাও।’
কাপড়চোপড় ছেড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন আর্কাদি সেমিওনভিচ।
‘কী এমন ঘটনা ঘটিয়েছে সে, বলো।’
‘ভয়াবহ সব ব্যাপারস্যাপার। গ্র্যানির কথা একদমই শোনে না। তাঁকে কাঁদিয়ে ছাড়ে। অতিষ্ঠ করে ফেলেছে একদম। তিনি চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।’
‘চলে যাবেন মানে!’ অবাক হলেন আর্কাদি সেমিওনভিচ।
‘মানে তো সহজ।’
‘বদমায়েশটাকে ধরে বসিয়ে দেব নাকি দু-এক ঘা!’
‘আর্কাদি, তোমার ধরনধারণ একেবারেই অসভ্য বর্বরদের মতো!’ চমকে উঠে স্ত্রী বললেন, ‘প্রস্তর যুগের। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে সবকিছু। বলতে হবে, অমন ব্যবহার করা উচিত নয়। পোক্ত কিছু উদাহরণ দিতে হবে। তুমি তো ওর বাবা, তাই না?’
‘তা বটে,’ মাথার পেছনটা চুলকাতে চুলকাতে বললেন আর্কাদি সেমিওনভিচ। ‘আচ্ছা, ডাকো দেখি ওকে। চেষ্টা করে দেখি।’
ঘরে এসে ঢুকল আলিওশা। চটপটে পাঁচ বছরের খুদে বালক।
‘কী ঘটনা ঘটিয়েছ, বলো শুনি।…কী, চুপ করে রইলে যে!’
আলিওশা কপাল কুঁচকে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল দরজার পাশে। মেঝেতে আঁকিবুঁকি কাটতে থাকল পা দিয়ে। বিপদ ঘনিয়ে এলে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতে প্রস্তুত।
‘আইসক্রিম কিনে দেয়নি কেন!’ অবশেষে বলল সে।
‘শুধু আইসক্রিমের কারণে তুমি তাঁর সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেছ? ছি! ছি! কী লজ্জা!’ ভুরু কুঁচকে পিতা বললেন। ‘তুমি কত্ত বড় খারাপ কাজ করেছ, সে সম্পর্কে ধারণা আছে তোমার?’
দুই পাশে মাথা ঝাঁকিয়ে আলিওশা জানাল, ধারণা নেই তার।
‘গ্র্যানি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে চাইছেন। তোমার সৌজন্যে! তিনি চলে গেলে আমরা কী করব, ভেবে দেখেছ?’
‘জানি না…।’
‘তোমার জন্য লাঞ্চ বানায় কে? উত্তর দাও।’
‘গ্র্যানি…’
‘কে তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয় প্রতিদিন?’
‘গ্র্যানি…।’
‘তোমার জামাকাপড় ধুয়ে দেয় কে?’
‘গ্র্যানি তোমার কাপড়ও তো ধুয়ে দেয়,’ সংশোধনী টানল আলিওশা।
‘তাহলেই বোঝো,’ পিতা বললেন। ‘ঘরদোর পরিষ্কার করে কে? তুমি কি বুঝতে পারছ যে সব দায়িত্ব গ্র্যানির কাঁধে?’
‘হুঁ,’ বলল আলিওশা।
‘অবশেষে!’ স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আর্কাদি সেমিওনভিচ বললেন।
‘আমি আর অমন ব্যবহার করব না,’ আলিওশা বলল নাকের শিকনি টেনে।
‘এই তো লক্ষ্মী ছেলে। এখন ঝটপট গ্র্যানির কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসো।’
আলিওশা ছুট লাগাল রান্নাঘরের দিকে। গ্র্যানি ওখানে ডিনার রান্নায় ব্যস্ত তখন।
‘গ্র্যানি!’ গ্র্যানির বুকে মুখ লুকাল আলিওশা। ‘আমাকে প্লিজ মাফ করে দাও। আমি এখন থেকে তোমার সব কথা শুনব।’
‘এই পাগলটা! মাফ চাইতে হবে কেন! আমি তো ও কথা সেই কখন ভুলে গেছি! তার চেয়ে বরং এই নাও, পিঠে খাও। বাদাম দেওয়া, তোমার যেমন প্রিয়।’
‘গ্র্যানি, তুমি নাকি এই বাসার সব কাজ করো? সত্যি?’
‘সত্যি। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছ?’
‘তুমিই যদি সব কাজ করো, তাহলে মা-বাবার দরকার কী?’
‘আলিওশা, তাদেরও একদিন নাতি-নাতনি হবে।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৪, ২০১১
Leave a Reply