ইংরেজিতে বলে থাকে মিথ্যা তিন রকম—মিথ্যে, ডাহা মিথ্যে আর স্ট্যাটিসটিকস। আমরা, স্বভাবত মিষ্টভাষী বাঙালিরা, তেমন করে বললে পরিসংখ্যানবিজ্ঞানের ওপর বড়ই অন্যায় করা হবে। ওই ইংরেজি প্রবচনটির বাংলা অনুবাদ হওয়া উচিত এই: সত্য তিন রকম—সত্যি, বউয়ের কাছে তিন সত্যি আর পরিসংখ্যান।
সেই গল্পটা আপনারা সবাই শুনেছেন। সেই যে দক্ষিণ আফ্রিকার জাঁদরেল প্রধানমন্ত্রী স্মাট্স যখন কালা আদমির চেয়ে সায়েবরা ক্রমবিবর্তনের ধাপে দু-সিঁড়ি উঁচুতে রয়েছে, এই তথ্যটা পার্লামেন্টে প্রমাণ করার জন্য জুতসই স্ট্যাটিসটিকস চেয়ে পাঠালেন পরিসংখ্যানের সেরা পণ্ডিতের কাছে; আর তিন দিন তিন রাত একনাগাড়ে লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি ঘেঁটে শেষ করেও সেই পণ্ডিত মশাই পরিসংখ্যান কায়দা করতে পারলেন না; তখন স্মাট্স সায়েব যা করেছিলেন—সেই গল্পটা? ঝুড়ি ঝুড়ি সংখ্যার ফুলঝুরি ফুটিয়ে পার্লামেন্টকে হতবাক করে তারপর বুড়বাক হয়ে যাওয়া পণ্ডিতের বিস্ময়কে আশ্বস্ত করেছিলেন উনি এই কথা বলে, ‘আরে মশায়, আপনিই যে পরিসংখ্যান কায়দা করতে পারলেন না তিন দিন বসে, পার্লামেন্টের সাধ্য কি তিন ঘণ্টার মধ্যে সেই সব বানিয়ে বলা সংখ্যার ভুল ধরবে?’
এ গল্পটা, আমার বিশ্বাস, একেবারেই বানানো গল্প। কিন্তু পরিসংখ্যান নিয়ে যত কথা শুনেছেন, তার সবগুলো বানানো নয় তাই বলে।
যেমন ধরুন, যে ভদ্রলোক ভাটার সময় খিদিরপুরের ছোটগঙ্গা হেঁটে পেরোতে গিয়ে সে বছর ডুবে মারা গিয়েছিলেন, তিনি যে সেচ বিভাগের পরিসংখ্যান থেকেই জেনেছিলেন, ভাটার সময় টালির নালার গড়পড়তা গভীরতা মাত্র দুই ফুট দেড় ইঞ্চি—এটা তো আর বানানো কথা নয়। চার ফুট আর শূন্য ফুটের গড় যে মাত্র দুই ফুট, এই সোজা কথাটা না বোঝাতেই এই বিপত্তি। গড়ের গড়খাইতে নিমজ্জন।
গড়ের মজায় শুধু ইনি নন, অনেকেই মজেছেন আরও। বিলেতের পাঞ্চ পত্রিকা একবার গড়ের পায়ে গড় করে লিখেছিল, ‘সরকারি পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারলুম, এ দেশের প্রত্যেকটি পূর্ণবয়স্কা স্ত্রী লোকের গড়পড়তা ২.২টি করে সন্তান আছে; আমরা বলি কি, ওই দশমিক ভগ্নাংশ বাচ্চা নিয়ে মেয়েদের নিশ্চয়ই ভারী অসুবিধে হচ্ছে, সরকার থেকে সাহায্যটাহায্য দিয়ে আরও দশমিক আট সন্তান প্রসব করার জন্য ওদের উৎ সাহ দেওয়া উচিত, যাতে করে প্রত্যেকটি মায়ের ছেলেপুলের সংখ্যা ভাঙাচোরা না থেকে গোটা গোটা হতে পারে।’ এমন একটা সংগত প্রস্তাবে কেন যে ব্রিটিশ সরকার কান দেয়নি, আমি তো কিছুতেই ভেবে পাই না।
ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আমি সেদিন এক লরি ড্রাইভারের সাফাই শুনেছিলাম। বেচারা নাকি কাকে চাপা দিয়ে ভবযন্ত্রণা ঘুচিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ বলে, লরিটা ঘণ্টায় আশি মাইল বেগে ছুটছিল সে সময়; কিন্তু পরিসংখ্যান দেখিয়ে ড্রাইভার প্রমাণ করে দিলে মশাই যে তার গাড়ির স্পিড গড়পড়তা ঘণ্টায় পাঁচ মাইলেরও কম ছিল।
কেননা, চাপা দেওয়ার আগেকার ২৪ ঘণ্টায় লরিটা মোট ১০৮ মাইল রাস্তা চলেছে, অর্থাৎ ১০৮ ডিভাইডেড বাই ২৪ ইকোয়েলস টু চার পয়েন্ট পাঁচ মাইলস পার আওয়ার; গড় হিসাবে এক রকম গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল গাড়িটা। তবু যদি কেউ তার নিচে চাপা পড়ে মারা যায়, তবে ড্রাইভারের দোষ কী?
আমি তো সত্যি বলতে কি, কোনো দোষ দেখতে পেলাম না ওর। একটা লোক মারা গিয়েছে, তা না হয় মেনেই নেওয়া গেল, কিন্তু লোকটা ওই লরির নিচে চাপা না পড়লেও তো মরতে পারত। ভেবে দেখতে গেলে, লোকটার মারা যাওয়ার সময় তো আসলে ঢের আগেই হয়ে গিয়েছে। বাঙালির গড় আয়ু ২১ বছর পার হওয়ার পরও সে যে বেঁচে ছিল তা থেকেই বোঝা যায় পরিসংখ্যানবিজ্ঞানের ওপর লোকটার একদম শ্রদ্ধা নেই; গড় সম্বন্ধে একদম আইডিয়া নেই ওর; কাজেই, আইডিয়ার একান্ত অভাববশতই, গড়ে পাঁচ মাইল স্পিডে চলা একটা গাড়ির ধাক্কায় অক্কা পেয়ে সেই জ্ঞানহীন লোকটা অবশেষে প্রমাণ করে গেল—স্ট্যাটিসটিকসকে হেলাফেলা করা কতখানি বিপজ্জনক।
নারায়ণ দাশশর্মা: ভারতীয় লেখক।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০৪, ২০১১
Leave a Reply