আর পনেরো ষোলো হাত গেলেই তীর পান, এমন সময়ে চকিতের মতো একটা কথা তাঁহার মনে হইল। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম শিহরিয়া উঠিলেন। কতকটা কণ্ঠে এবং কতকটা ইঙ্গিতে কুম্মারাপ্পাকে প্রশ্ন করিলেন, দড়িটা কত হাত?
পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম এক্কেবারে মরিয়া গেলেন।
অপরাধ তাঁহার নয়। তিনি আত্মরক্ষা করিতেই চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিবেককে অক্ষুণ্ন রাখিতে গিয়া দেহকে অনাহত রাখিতে পারেন নাই। দুই দিক একসঙ্গে সামলাইবার সামর্থ্য যদি বিধাতা তাঁহাকে না দিয়া থাকেন, সে ত্রুটি বিধাতার।
বিধাতার ত্রুটি, এমন কথা বলিবার সাহস অবশ্য সকলে রাখে না। তাহারা বলিবে, দোষ সমস্তটাই কুম্মারাপ্পার। সে যদি অমন অতর্কিতে অকুস্থলে আসিয়া উপস্থিত না হইত, তবে দুর্বিপাকটাও ঘটিত না।
ব্যাপারটা ঘটিয়াছিল এইরূপ। প্রাতঃকালে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম একটি ঘটি ও একটি দাঁতনকাঠি হাতে লইয়া বাহির হইয়াছিলেন। দেহশুদ্ধি সমাধা করিয়া তিনি নদীর জলে নামিয়া হস্তপদ প্রক্ষালন করিলেন। তারপর মৃদুস্বরে গীতার দশম অধ্যায় আবৃত্তি করিতে করিতে গৃহাভিমুখী হইলেন।
নদীর পাড় ধরিয়া পথ। বেদনাং সামবেদোহস্মি নক্ষত্রাণামহং শশী—বলিতে বলিতে অগ্রসর হইতেছেন, এমন সময়ে আচম্বিতে পথের বাঁক ঘুরিয়া কুম্মারাপ্পা দেখা দিল।
পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম থমকিয়া দাঁড়াইলেন। তিনি শুদ্ধাচারী শুদ্ধবংশসম্ভূত নম্বুদ্রি ব্রাহ্মণ। কুম্মারাপ্পা পারিয়া শূদ্র। শাস্ত্রমতে তাঁহার নিকটস্থ হইবার অধিকার কুম্মারাপ্পার নাই।
এই নিষেধ একদিনের নহে, চির আচরিত বিধি। তিন হাজার সাত শত পঁচাশি বৎসর পূর্বে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণমের দ্বাদশশতোত্তর ত্রিপঞ্চাশ পিতামহ স্বজাতীয় আর্যসেনার সহিত দাক্ষিণাত্যে অভিযান করিয়াছিলেন। তিন হাজার সাত শত পঁচাশি বৎসর পূর্বে দ্রাবিড় কুম্মারাপ্পার দ্বাদশশতোত্তর ত্রিপঞ্চাশ পিতামহ সেই অভিযানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়া আর্য সংস্কৃতি বিস্তারের সেই সাধু প্রচেষ্টাকে বাধা দিতে চাহিয়াছিল। সেই অপরাধে তাহার ও তাহার বংশের যে যেখানে জন্মগ্রহণ করিবে সকলেরই আত্মা কলুষিত। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম যে স্থানে থাকিবেন তাহার আশি হাতের মধ্যে কুম্মারাপ্পা আসিতে পারে না। আসিলে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণমকে স্নান ও প্রায়শ্চিত্ত করিয়া শুদ্ধ হইতে হয়।
অসময়ে অবহেলায় স্নান করা তাঁহার স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনুকূল নয়। তাই কুম্মারাপ্পার গলায় একটা ঘণ্টা ঝুলাইয়া দেওয়া হইয়াছে, যেন দূর হইতেই ঘণ্টার শব্দ শুনিয়া পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম সতর্ক হইতে পারেন।
কুম্মারাপ্পাকে দেখিয়া পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম ভ্রূকুঞ্চিত করিলেন। ঘণ্টার শব্দ তাঁহার কর্ণগোচর হয় নাই। দূর হইতে তীক্ষ্নদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া দেখিলেন কুম্মারাপ্পার গলায় ঘণ্টাটি বাঁধা আছে। তাহার দোলকটি কোনো প্রকারে আটকাইয়া গিয়া থাকিবে, ঘণ্টার শব্দ হইতেছে না।
কুম্মারাপ্পা আকাশ ও নদীর দিকে চাহিয়াছিল। ভ্রূকুটি কবিতানন পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটরানায়ণমকে সে দেখিতে পাইল না। অসঙ্কোচগতিতে নদীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। নদীর চরায় তাহার নৌকাটি তোলা রহিয়াছে, ঝড় আসন্ন, তাহার দৃষ্টি তাই নদীর দিকে।
উভয়ের মধ্যে ব্যবধান কমিয়া আসিতেছিল। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম শঙ্কিত দৃষ্টি ফেলিয়া ব্যবধানটুকু মাপিয়া দেখিতে লাগিলেন। ব্যবধান আশি হাতের কম হইলেই স্পর্শদোষ ঘটিবে। তাঁহাকে স্নান ও প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। মাঘ প্রভাতের দুরন্ত শীতে তাঁহার স্নান করিবার উৎসাহ ছিল না।
কুম্মারাপ্পা অগ্রসর হইতেছিল। তাহার প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণমও এক পা এক পা করিয়া পিছনে হটিতে লাগিলেন।
মাথার পিছনে বুদ্ধিহীন বিধাতা চক্ষু দেন নাই, হটিতে হটিতে ক্রমে তিনি নদীর কিনারায় গিয়া পড়িলেন। তারপর আর এক পা হটিতে যাইয়া একেবারে খাড়া পাড় ডিঙাইয়া নদীতে পড়িয়া গেলেন। পড়িতে পড়িতে চীৎকার করিয়া উঠিলেন।
চীৎকার কুম্মারাপ্পার কানে গেল। ব্যস্ত হইয়া সে নদীর কিনারায় ছুটিয়া আসিল। ঝুঁকিয়া দেখিল, পণ্ডিত বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম প্রখর স্রোতে হাবুডুবু খাইতে খাইতে ভাসিয়া চলিয়াছেন।
কুম্মারাপ্পা চীৎকার করিয়া কহিল, ভয় নাই।
পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম অতি কষ্টে মুখ তুলিয়া চাহিলেন। কুম্মারাপ্পা সত্যই বলিয়াছে, ভয় নাই। তখন কুম্মারাপ্পা ও তাঁহার মধ্যে ব্যবধান অন্যূন দুই শত হাত। আশি হাতের কম হইলেই স্নান করিতে হইত। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম আরেক ঢোক জল খাইলেন।
কুম্মারাপ্পা নদীর তীর ধরিয়া দৌড়াইতে লাগিল। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম প্রাণপণে ডাকিয়া কহিলেন, দেখিস বেশি কাছে আসিস না।
সে ক্ষীণ কণ্ঠ কুম্মারাপ্পা শুনিতে পাইল না। যেখানে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম ভাসিয়া যাইতেছিলেন, তাহা ছাড়াইয়া আরও কিছুদূর গিয়া সে দাঁড়াইল। তাহার কোমরে মস্ত বড় একটা দড়ির বাণ্ডিল ছিল—তাহার নৌকার গুণদড়ি, সেই দড়ি খুলিয়া সে একটা দিক নদীর মধ্যে ছাড়িয়া দিল। অব্যর্থ লক্ষ্য। দড়িটা একেবারে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণমের গায়ে গিয়া পড়িল। প্রাণপণে সেটাকে তিনি আঁকড়াইয়া ধরিলেন।
কুম্মারাপ্পা আবার চীৎকার করিল, ভয় নাই।
তীরের ওপরে একটা বাবলাগাছ। তাহার গায়ে ভর রাখিয়া কুম্মারাপ্পা ধীরে ধীরে দড়ি টানিতে লাগিল। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম তীরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
অগ্রসর হইতে হইতে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম মুখ তুলিয়া চাহিলেন। কথা বলিবার শক্তি নাই, হস্তের ইঙ্গিতে কুম্মারাপ্পাকে বলিলেন, সরিয়া যাও।
কুম্মারাপ্পা বুঝিল। গাছের গায়ে দড়ি ঠেকাইয়া সে টানে টানে পিছনে হটিতে লাগিল। ব্রাহ্মণকে সেই শীতে স্নান করাইয়া তাহার কোনো লাভ নাই। ক্রমে পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম তীরের নিকট আসিয়া পড়িলেন। চাহিয়া দেখিলেন, কুম্মারাপ্পা নদীর তীর ধরিয়া চলিতেছে।
আর পনেরো ষোলো হাত গেলেই তীর পান এমন সময়ে চকিতের মতো একটা কথা তাঁহার মনে হইল। পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম শিহরিয়া উঠিলেন। কতকটা কণ্ঠে এবং কতকটা ইঙ্গিতে কুম্মারাপ্পাকে প্রশ্ন করিলেন, দড়িটা কত হাত?
কুম্মারাপ্পা কহিল, তিয়াত্তর হাত।
হা অদৃষ্ট!
কপালে করাঘাত করিয়া পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম দড়ি ছাড়িয়া দিলেন। দিয়াই জলে তলাইয়া গেলেন।
শাস্ত্রবচন হইতে দড়ি সাত হাত খাটো পড়িয়াছিল। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সেই সাত হাতের ব্যবধান পণ্ডিত রামেশ্বর বালগঙ্গাধর ভেঙ্কটনারায়ণম পার হইতে পারিলেন না।
[ঈষৎ সংক্ষেপিত]
অমূল্য দাশগুপ্ত—ভারতীয় লেখক। জন্ম: ১৯১১, মৃত্যু: ১৯৭৩
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ২৭, ২০১১
Leave a Reply